ইছামতী উপন্যাসে নায়ক ভবানী বন্দ্যোপাধ্যায়

    বিভূতভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিখ্যাত উপন্যাস ইছামতি। লেখকের বিভিন্ন লেখার মধ্যে প্রকৃতি  অনাড়ম্বর ও কাঙ্ক্ষিত রূপে প্রবেশ করেছে, সেই দিক থেকে লেখকের শৈশব জড়িত ইছামতি নদী কে কেন্দ্র করে তার লেখা ইছামতি উপন্যাস। এই লেখার সাথে মানিক বন্দোপাধ্যায় এর পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কিছুটা মিল থাকলেও তা বৈশিষ্ট্য গত। এই উপন্যাসের  নায়ক চরিত্র ভবানী বন্দোপাধ্যায় সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।


ইছামতী  উপন্যাসে নায়ক ভবানী বন্দ্যোপাধ্যায়


    ভবানী বন্দোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ উপন্যাসে নায়ক পদবাচ্য চরিত্র। কিন্তু তিনি সত্যিকারের নায়ক নন। কারণ নিস্তারিণীর মত দু-একটি চরিত্র তার দ্বারা সামান্য একটু প্রভাবিত হলেও অন্য কোন চরিত্র গভীরভাবে প্রভাবিত হয়নি এবং উপন্যাস কাহিনীর গতিবেগও তিনি সক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেননি। তাছাড়া বিভূতিভূষণ হয়তো কোনো মনুষ্য চরিত্রকে এই উপন্যাসে নায়ক করতে চাননি।

   ইছামতি নদী এখানে মহাকাল ও অনন্ত জীবন প্রবাহের প্রতীক। গননাতীত উমিপুঞ্জো নিয়ে যেমন নদীপ্রবাহের সৃষ্টি, এই নদী লালিত মানুষ গুলিও তেমনি অখন্ড কাল প্রবাহের এক একটি ঢেউ। ভবানীও তাদের মধ্যে একজন। তবে এই উপন্যাসের মুক মনুষ্যের সমগোত্রীয় হয়েও অনেক বেশি প্রাঞ্জল, সচল, সচেতন,  সহৃদয় ও সংস্কারমুক্ত চিন্তার অধিকারী। অনেকের মধ্যে থেকেও তিনি অনেক বেশি উরস্ব‌‍‍‍‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌চা‌‍রী জগতের অধিবাসী। কিন্তু তিনি অবাস্তব নন, বাস্তব সমাজের ধূলি-ধূসর পথেই তার অধিযাত্রা।

    ভবানী বস্তুনিষ্ট পারিপার্শ্বিক জীবন ও লেখকর মন্ময় জীবনবোধের সম্মিলিত রূপ। তবে তন্ময়তা (Objectivity) অপেক্ষা মন্ময়তাই (Subjectivity) চরিত্রটির মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে। এই মন্ময়তার সূত্রে এসেছে বিভূতিভূষণের প্রকৃতির প্রতি রোমান্টিক কবি দৃষ্টি এবং আধ্যাত্মিকতা বোধ। অমৃতধারাবাহিনী ইছামতির কলস্বনে ভবানী যেমন শুনেছেন ভূমির বাণী তেমনি ইছামতির কাছেই লাভ করেছেন ভূমিকে ভালোবাসার দীক্ষা।

   এই প্রকৃতি চেতনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে তার আধ্যাত্মিকতা বোধ। তার জীবনপ্রেম, মানুষ, প্রকৃতি এবং ঈশ্বরের এই তিন দেবতার প্রতি ভালোবাসা ঈশ্বর তার কাছে বাস্তব সত্য — তিনি আছেন —  “ তাই এই মা আছে,ছেলে আছে,ফুল আছে,স্নেহ আছে,আত্মত্যাগ আছে,সেবা আছে প্রেমিকা আছে, প্রেমিক আছে” প্রেম তার পূজা তাই তিনি প্রার্থনা করেছেন —  “সংসার বর্জন করে নয় সংসারে থেকেই সেই দৃষ্টি লাভ করতে পারার মন্ত্র ইছামতি তাকে যেন দান করে।”

    এই খন্ডের মধ্যে অখন্ডকে দেখা, ভান্ডের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ড দর্শন — এই বোধ সীমা এবং অসীমকে এক পরম মানবপ্রেমের সূত্রে বিধৃত করেছে বলে ভবানী তথা বিভূতিভূষণের আধ্যাত্বিক দৃষ্টি ইছামতী উপন্যাসে অধিকতর পরিপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে এই দৃষ্টি যথার্থ কবির দৃষ্টি।

    উপনিষদের ঋষিদের মতো এ কবি দৃষ্টি নিয়ে তিনি ঈশ্বর, জগৎ ও জীবনকে আনন্দ রূপে দেখেছেন।‘আনন্দ রুপম মৃত্রং যদ্ বিভাতি’ তার মনে হয়েছে ঈশ্বর ও একজন কবি সর্বমানবের প্রতি এই সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়েই ভবানী বন্দোপাধ্যায়ের উপলব্ধি করেছেন — এ হলা পেকে এই নিস্তারিণী কাউকে তিনি অবহেলা করবেন না। সবাইকে তার দরকার।

    ভবানীর মানবপ্রীতি কোনো ভালোমন্দ বিচার করেনি তিনি খুনে হলা পেকেকে ঘৃণা করেননি। উন্মার্গ গামিনী বলে নিস্তারিণীকে দূরে ঠেলেননি। আবার সাধনভ্রষ্টা সন্ন্যাসিনী খেপির আশ্রমে নির্দ্বিধায় গেছেন। স্বৈরিণী গয়ামেমও তার স্নেহপ্রীতি পেয়েছেন। তিনি রামকৃষ্ণ কথিত পাকাল মাছের মতো সংসারে পঙ্কে থেকেছেন। কিন্তু তার অঙ্গে ও অন্তরে মালিন্যের স্পর্শ নেই। নারীরা তার সান্নিধ্যে এসে স্নেহ পায়। তাকে শ্রদ্ধা করে কিন্তু কোন পাপ বাসনা তাদের মধ্যে আর স্থান পেতে পারে না। তিনি জ্ঞানী কিন্তু জ্ঞানের গরিমা নেই। রামকানাই কবিরাজের সহজ-সরল বিশ্বাসের প্রতি তিনি শ্রদ্ধায় নত হয়েছেন।

    পাঁচপোতা গ্রামের শ্যাওলা ছাতার      দলে-ভবা বদ্ধ জীবনে ভবানীই একমাত্র মুক্ত জীবনের অধিকারী। যখন গ্রামের মূঢ়হ মুক মানুষগুলো সংকীর্ণ স্বার্থ নিয়ে পরস্পরে দলাদলি করে হানাহানি করে,তিনি তখন অর্থ ও স্বার্থের প্রলোভন ত্যাগ করে পারমার্থিক চিন্তায় রত। কিন্তু আশ্চর্যভাবে তিনি বাস্তবযুগ সচেতন ও সমকাল ছাড়িয়ে যে আরেক নতুন কালে আসেন তাও তার ক্লান্ত দৃষ্টিতে ধরা পড়ে।

   তিনি সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে বিদেশী চিত্রকারের কাছে পত্নীর চিত্র আঁকাতে চান। নিস্তারিণীর মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবাদী নারীশক্তিকে প্রশংসা করেন। এছাড়া তার খোকা একদিন বড় হয়ে প্রকাশ্য রাস্তা ধরে বউয়ের হাত ধরে বেড়াতে যাবে কেউ কিছু বলবে না — সেই দিনের ছবি তার দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এই ভবানী অতিক্রান্ত যৌবনে পৌরত্বের সীমায় পৌঁছে তিনটি কুলীন  কন্যার পাণি গ্রহণ করল।
ইছামতী উপন্যাসে নায়ক ভবানী বন্দ্যোপাধ্যায়


   এখানেও মানুষের প্রতি তার গভীর ভালবাসার পরিচয় পাওয়া যায়। ইন্দ্রিয় চরিতার্থতা অপেক্ষা অরক্ষনীয় কুলীন কুমারীদের বেদনায় তাকে এই বিবাহে বিশেষভাবে আগ্রহী করেছে। তিলু বিলু নীলুর সঙ্গে ভবানীর পরিণয় ঘটিয়ে লেখক নারীর তিনটি রূপের গৃহিণী প্রেয়সী ও সখি এর ভাবমূর্তিকে প্রকাশ করতে চায়।

    ভবানী তার আধ্যাত্বিক সম্পদ যতটা পেরেছেন খোকা টুলুকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। খোকাও তার কাছে সামান্য একটি শিশু নই। সে মহৎ শিল্পী ঈশ্বরের প্রতিভার অবদান বস্তুত ইছামতি রণোকালে বিভূতিভূষণ পিতৃত্বের অধিকারী হয়েছেন। তাই ভবানীর মধ্যে তিনি নিজে পিতৃসত্তাকে সার্থকতার সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। 

  তিনি বিদেশী গ্রান্টের নিকট ভারতীয় ঋষির প্রতিরূপ মহাজীবনযাত্রার  অক্লান্ত পথিক দীনদুঃখী পাপীতাপী মুক জনগণের পরমসূরী,  স্নেহময় পিতা। তাই নায়ক না হয়ে এই উপন্যাসে ভবানী বন্দ্যোপাধ্যায় অনেকটাই নায়কোচিত মহিমা লাভ করেছেন। বিভূতিভূষণের পরিণত প্রতিভার তিনি এক মহোত্তম সৃষ্টি।


এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রশ্নগুলি 


TAG :: ইছামতী উপন্যাস, ইছামতী, ইছামতি উপন্যাস, ইছামতী উপন্যাস। প্রথম খন্ড।, ইছামতী উপন্যাসের বিষয়বস্তু, ইছামতী উপন্যাসের প্রশ্ন উত্তর, ইছামতী উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত কাহিনী, ইছামতী উপন্যাসের ছোট প্রশ্ন পর্ব এক, 'ইছামতী' উপন্যাস দুটি কে কে লিখেছেন?, ইছামতী উপন্যাসের রাজারাম চরিত্র বিচার, ইছামতী উপন্যাসের আলোচনাসহ প্রশ্নোত্তর, ইছামতী উপন্যাসের ছোট প্রশ্ন উত্তর আলোচনা, ইছামতী উপন্যাসের নিস্তারিণী চরিত্র বিচার, ভবানী বাড়ুয্যে কী শেষে বিবাহ করবে। ইছামতী উপন্যাস, ইছামতি