হাঁসুলিবাঁক উপন্যাসে বনওয়ারি চরিত্র | হাঁসুলিবাঁকের উপকথা | তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়

কাহার, বাউরি, সাওতাল, ডোম প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কথা যে সাহিত্যিক প্রথম লেখনী রূপে তুলে ধরেছিল তিনি তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় । তাকে ইংরেজি সাহিত্যের টমাস হার্ডির সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। তার হাসুলি বাঁকের উপকথা উপন্যাস টি অন্যতম এবং বেশ উল্লেখযোগ্য। এই উপন্যাসের বনওয়ারি চরিত্র সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।


হাঁসুলিবাঁক উপন্যাসে বনওয়ারি চরিত্র


হাঁসুলিবাঁক উপন্যাসে বনওয়ারি চরিত্র


    হাঁসুলিবাঁকের উপকথার প্রধানতম চরিত্র বনওয়ারী। কোপাই এর তীরবর্তী কাহার কলের সে প্রতিনিধি। আলোচ্য উপন্যাসে কাহিনীর উত্থান-পতন তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।

    করালি অত্যাচারী কাহার কুলের মূর্তিমান প্রতিবাদ কর্তাবাবার বাহনকেসে পুড়িয়ে মারার স্পর্ধা দেখায়। বাবুদের বকশিসে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। বাঁশবাদির অতিপ্রাকৃত জগতকে পিছনে ফেলে সে অবলীলাক্রমে চন্দনপুরে চলে যায়। কিন্তু বনোয়ারী এ সমাজের প্রতিনিধি সে মাতব্বর, “সকল কর্মের উপরে হলো তার মাতব্বরির দায়িত্ব ”,গ্রামের ভালো আগে দেখতে হবে তাকে। করালির উদ্ধত বেপরোয়া চালচলন তাকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। বনওয়ারি বিশ্বাস করে করালির অপবাদের ফলে কাহার পাড়ায় নানা রকম বিপদ ঘটতে শুরু করেছে। তাই সকলে সাবধান করতে লাগলো।

    করালির সান্নিধ্যে বর্জন করার জন্য করালির পাপের জন্য সে পাঠা বলি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে চেয়েছে। কারণ সে যে পাড়ার অভিভাবক সে বিশ্বাস করে —

   “এই যে মাতব্বর এরচেয়ে ঝকমারির কাজ            আর কিছু নাই,বাজার দোষে রাজ্য নাশ              মন্ডপে দোষে গ্রাম নাশ,প্রজার পাপে রাজ্য          নষ্ট,গ্রামের পাবে মন্ডবের মাথায় বজ্রপাত ”

    এই চেতনার ফলে বাঁশবাদীর আদিম অন্ধকারাচ্ছন্ন বাঁশবনে কোপাইয়ের বুক থেকে ছুটে আসা হরকা বানের মত যৌবন পিপাসার লাবণ্যে তাকে প্লাবিত করে দিলেও পরস্ত্রীকালো শশীকে পায় না।

    করালী মাইতো ঘোষকে মানেনা। বনওয়ারীকে সে তো পাত্তাই দেয় না অথচ পাড়ার আসরে বনওয়ারী ঘোষণা করে সে করালীর চালচলন সহ্য করবে না। এমনকি সম্মানীয় দারগাকেও সে করালি সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছে অথচ দারোগার চোখে করালী বাহাদুর ছোকরা সাপ মারার জন্য পাঁচ টাকা বকশিস দেওয়া হবে। করালি ও পাখিকে কেন্দ্র করে পাড়ার নতুন যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে,কালো শশীর কথা মনে পাড়ায় সে সমস্যার সঙ্গে আর নিজেকে জড়াতে চায় না। কাহারপাড়ায় দলাদলির প্রধান মুরুব্বিদের প্রতি করালির ক্রোধ অপরিসীম বৃদ্ধি পায়। বনওয়ারীর সঙ্গে তার মারামারি এবং বনোয়ারীর পরাজয়ের কথা সে বীরবিক্রমে জানিয়ে দেয়।

    বনওয়ারির পরাজয় কাহার পাড়ার কাছে রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার। সে শুধু তাদের মাতব্বরই নয় তার নির্দেশে রেললাইনে কুলি গ্যাঙের বিস্তর অধিবাসীন স্বৈরিণীরা কাহার পাড়ায় প্রবেশ করতে পারে।

    সিধু ও জগদ্ধাত্রীর প্রতি স্নেহশীল প্রীতি এই ধরনের বোধের ফলে তাঁর আদেশ অমান্যকর ও সাহস ওদের নেই। এমনকি অসমবেন কোপাই নিজের বাসায় আসতে দেখে করালি মত দুঃখী যাত্রী স্বেচ্ছাচারী ও মুখ শুকিয়ে যায় বনোয়ারি এসেছে করালো পাখিকে নিজেদের এলাকায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সাময়িকভাবে করালি যেন তার বস তার শিকার করে পায়ে হাত দিয়ে প্রমাণ করলে বনোয়ারী ও মন আত্মতৃপ্তিতে ভরে যায় তাই প্রহ্লাদ নয়নের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও করালি পাখিকে গ্রামে ফিরে আনার একটা যুক্তি কথা সে খুঁজে পায় আর এই সুযোগে তাকে বারবার প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে — 

 “ পঞ্চায়েতের হুকুম অমান্য করা চলবেনা,            দেবতা গোসাইকে মানতে হবে, অনাচার              অধর্ম করবে না। প্রধান মুরুব্বির রুপমান            কখনো করবে না। করালী সে প্রতিজ্ঞা করেছে। ”


    বনওয়ারি সৎ, সে শালের চালায় থাকলে গুর চুরি হয় না। শান্তিবাদী-গান্ধীবাদের কথা সে ভালোবাসে। সে সমাজকে ভাঙতে দিতে চায়না। করালীকে দিয়ে সে কাহার পাড়ায় ‘ইতি মঙ্গল’ করতে চাই। সে চায়না সম্মানীয় যুবকেরা কৃষিকাজ ও পালকি বহন পরিত্যাগ করে পৃতৃ পুরুষের কুলধর্মে জলাঞ্জলি দিয়ে কলকারখানার তেল কালী ভরা অলক্ষ্মীর-পুরী ধর্ম না মানার এলাকায় চলে যায়।

    কালো শশী ও তাকে কেন্দ্র করে আটপৌড়ে পাড়ায় গীত রচনা হওয়াতে তার নীতিবোধ আঘাত লাগে। সে বাবার বাহনের হত্যাকারী করালীকে সমাদর করায় নিজেকে অপরাধী বলে মনে করতে থাকে। নীতিবর্জিত প্রেমের জন্য সে প্রায়শ্চিত্ত করতে,যথাযথ মনে করে। বর্ষার সময় তেরপেল এনে বনওয়ারিকে সাহায্য করায় করালীর প্রতি সে অত্যন্ত খুশি হয়।

    আত্মসম্মানের প্রশ্নে হোদামন্ডলের সঙ্গে বিবাদে করালীকেই সমর্থন করে বনওয়ারী —

    “ কথাটা করালি বলেছে ঠিকই তবে এমন               চড়ে উঠানো বললেই হতো। ”

    বনওয়ারি বুঝেছে করালি থেকেই কাহার পাড়ার চরম সর্বনাশ হবে নয়তো চরম মঙ্গল হবে। সর্বনাশের পথে যদি ঝোকে তবে বনওয়ারী তাকে ক্ষমা করবেনা। করালীকে পুত্রের মত নিঃসন্তান বনওয়ারী হিন্দু খালাসিদের সঙ্গে মুসলমান খালাসিদের দাঙ্গায় করালীর অমিত বিশ্বাসের কথা শুনে আফসোস করে — 

     “ ছোকরাটা যদি করালীর পুত্র হত, করালীও         আজকাল খুচরার মতো অনেকটা                     ভালোবাসতে শুরু করেছিল। তাই                     সর্বসমক্ষে বনওয়ারীর পায়ে হাত দিয়ে               প্রতিজ্ঞা করেছিল আটপৌরে পাড়ায় আর           কখনো সে লাঠি খেলতে যাবে না। ধার্মিক           লোক বনওয়ারিকে সে একশো বার হাজার          বার মানবে। ”

    কিন্তু করালি বাবা ঠাকুরের আশ্চর্য আদ্দিকালের শিমুল গাছের ডালে উঠে বৈদ্যুতিক তারে আগত ঝড়ের বার্তা প্রচার করে। ঝড়ে বাবা ঠাকুরের বেল গাছ পড়ে গেলে আতঙ্কিত কাহার দের সামনে বিদ্রুপ করে বলে বাবা ঠাকুরের ‘ ডিঙ্গ উল্টাগাছ ’ এবং পরিণতিতে লিপ্ত হয় ও তার মাথায় লাথি মেরে তার দ্বিতীয় স্ত্রী সুবাসিকে নিয়ে নিজের আস্তানায় ওঠে।

    এই বনওয়ারী ও করালি কিন্তু একে অপরের সমান্তরাল নয়, পরিপূরক। দেবু ঘোষের সঙ্গেও তার পার্থক্যবাদী সম্প্রদায়ের নির্মম নির্যাতন সত্ত্বেও বনওয়ারী তাদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভক্তি পরায়ন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ঘোষ বাড়ির লক্ষীর এঁটোকাটায় বনওয়ারীর পিতৃ-পরুষের জেবন। মনিবেরা বিদ্যমান ও জ্ঞানবান। প্রয়োজন হলে কাহার দের পক্ষ নিয়ে প্রতিপক্ষদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদও করে। তার কাছে কর্তাবাবার পরেই মনিবের স্থান। ভদ্রজনদের লালসাবহ্নিতে নিজেদের মেয়েদের দেহ সমর্পণকে সে বিধির বিধান বলে মান্যে করে।

    শাসক ও শোষণের প্রতি এই ধরনের প্রচন্ড অনুগত্য সত্বেও বনওয়ারী লেখোকের সপ্রশংস শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেছে। কারণ কোপাইয়ের তীরবর্তী কাহার সম্প্রদায়ের উৎসাদনে মৃত্যুপথযাত্রী বনওয়ারীর বিপন্নতা একালের যন্ত্র শাসিত সভ্যতার প্রতি লেখক এর বিরূপতা মনে করিয়ে দেয়। কাহিনীর উপসংহারে স্পষ্ট বোঝা যায় করালী নয়,বনওয়ারী লেখকের কাছে মানুষ প্রতিভূ। এই বনওয়ারী শক্তি, ইশা, প্রেম,পাপ ও পতনের দিক থেকে যে হাঁসুলীবাঁকের কুঢল সাঙ্কল খামখেয়ালি নৈসর্গিক রূপের প্রতীক হাঁসুলীবাঁকের স্থবির ভয়ঙ্কর নিশ্চলতা চরিত্রকে অপরূপ করে গড়ে তুলেছে।



এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রশ্নগুলি 

TAG ::  হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাস, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে সুচাঁদ, বাংলা উপন্যাস, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে গ্রাম সমাজের বিবর্তন, উপন্যাস, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলিবাঁকের উপকথা, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে নসুবালা চরিত্র বিচার, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা চরিত্র, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা pdf download, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা প্রশ্ন। উত্তর, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা আলোচনা, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়