পূর্বরাগ কি ? বৈষ্ণব পদাবলীতে পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করো - pdf
বৈষ্ণব পদাবলীতে পূর্বরাগ একটি বিশিষ্ট অধ্যায়ে। পূর্বরাগ বিষয়টি রাধা ও কৃষ্ণের উভয়ের বর্ণনা করা আছে। আমরা এখানে পূর্বরাগের সম্পর্কে এবং বৈষ্ণব পদাবলীতে পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করব। আপনার প্রয়োজন অনুসারে আপনি নোট টি লিখে নিতে পারেন।
পূর্বরাগ কি ?
বৈষ্ণব পদাবলীর পূর্বরাগ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে গেলে তার তত্ত্বগত দিক সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। এই কারণে আমরা পূর্বরাগের বিভিন্ন তত্ত্বগত পরিচয় সম্পর্কে জেনে নেবো ।
Educostudy.in/পূর্বরাগ |
পূর্বরাগের তত্ত্বগত পরিচয়
শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে মধুর রস বা শৃঙ্গার রসকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন-
- বিপ্রলম্ভ
- সম্ভোগ
বিপ্রলম্ভের আবার চারটি বিভাগ করেছেন-
- পূর্বরাগ
- মান
- প্রেমবৈচিত্ত্য বা আক্ষেপানুরাগ
- প্রবাস
বিপ্রলম্ভের প্রথম পর্যায় হল পূর্বরাগ। শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে পূর্বরাগের সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে –
“রতির্যা সঙ্গমাৎপুর্বং দর্শন শ্রবণদিজা।
তয়োরুন্মীলতি প্রাজ্ঞৈঃ পূর্বরাগ স উচ্যতে।।”
অর্থাৎ যে রতি মিলনের পূর্বে দর্শন ও শ্রবণাদির দ্বারা উৎপন্ন হয়ে নায়ক-নায়িকা উভয়ের হৃদয়কে উন্মিলিত করে তারই নাম পূর্বরাগ। পূর্বরাগ কৃষ্ণের হতে পারে, রাধারও হতে পারে। কিন্তু রাধার পূর্বরাগই শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। কৃষ্ণ বিষয়ক রতির গভীরতার ভিত্তিতে পূর্বরাগের তিনটি বিভাগ -
- সাধারণী
- সমঞ্জসা
- প্রৌঢ়া
প্রৌঢ়া পূর্বরাগের প্রধান তিনটি সঞ্চারী ভাব হল-
- লালসা
- উদ্বেগ
- জাগরণ
- কৃশতা
- জড়িমা
- বৈয়গ্র্য বা ব্যাগ্রতা
- বাধা
- উন্মাদ
- মোহ
- মৃতি বা মৃত্যু বাসনা
সমঞ্জসা পূর্বরাগের দশটি দশা। কিন্তু সাধারণ পূর্বরাগের দশা মাত্র ছয়টি। শ্রীরূপগোস্বামী পূর্বরাগকে প্রধানত দুটি ভাগে করেছেন –
- দর্শনজাত
- শ্রবণজাত।
কবিকর্ণপুর দর্শনের তিনটি ভাগ উল্লেখ করেছেন –
- সাক্ষাৎ দর্শন
- চিত্রপটে দর্শন
- স্বপ্নে দর্শন।
তিনি শ্রবণের আবার পাঁচটি ভাগ করেছেন –
- বন্দীমুখে শ্রবণ
- দূতীমুখে শ্রবণ
- সখিমুখে শ্রবণ
- গুণীজনের কাছে শ্রবণ
- বংশীধ্বনি শ্রবণ।
পদাবলী সাহিত্যের শ্রীরাধার এই পূর্বরাগ কবিদের কাছে বড় আকর্ষণীয় বিষয়। ইংরাজীতে যাকে বলে ‘Love at first sight’ পূর্বরাগের কোন কোন অংশের সাথে তার সাদৃশ্য আছে। বোধকরি শুধু বৈষ্ণব সাহিত্যেই নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে প্রেমের এই অতলান্ত গভীরতা ও তার থেকে জাত বেদনা নিয়ে বহু সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। যদিও একথা সত্য বৈষ্ণবের কবিতা মূলত বৈকুণ্ঠেরই জন্য এক আধ্যাত্মিক আরাধনার সংকেত সবসময়ই এখানে পাওয়া যায়। তবুও অপ্রাপ্তির বেদনা প্রাপ্তির প্রত্যাশার সঙ্গে মিশে যে অনন্ত প্রতীক্ষার অসামান্য ছবি তৈরি করেছে পূর্বরাগের কবিতাগুলিতে নিঃসন্দেহে তা পরবর্তী রোমান্টিকতার পূর্বাভাস।
পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি
পদাবলী সাহিত্যে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস এবং গোবিন্দদাস এই চারজন কবি পূর্বরাগ পর্যায়ের বহু মূল্যবান পদ রচনা করেছেন। কিন্তু দ্বিজ চণ্ডীদাস পূর্বরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি। চণ্ডীদাস প্রথম থেকেই রাধার বৈরাগ্যবিধুর তপস্বিনী মূর্তি অঙ্কন করেছেন। চণ্ডীদাসের কবিতায় রাধার প্রেম এক গভীরতম জীবনরসের নির্যাস। কবি সুন্দরভাবে যে রাধার তাপসী মূর্তি এঁকেছেন তার নিদর্শন পাই এই পদটিতে –
“সই কে বা শুনাইল শ্যাম নাম
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ।”
এই শ্রবণজাত পূর্বরাগে আক্রান্ত রাধা শুধু শ্যাম নামের মাধুর্যেই ভাববিহ্বল। এতই তার মাধুর্য যে কিছুতেই সে নাম কান থেকে সরছে না। কৃষ্ণনাম জপ করতে করতে রাধার সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে যায়। শুধু নামের শক্তিতেই রাধা জীবিত আছেন। নামোচ্চারণেই যদি এত ব্যাকুলতা জন্মায় তবে কৃষ্ণের দেহের স্পর্শে আরও সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে। সদ্যজাত প্রেমাঙ্কুর আজ তার সম্পদ। কৃষ্ণকে ভোলার চেষ্টা করেও রাধা এক্ষেত্রে অপারগ হন –
“পাসরিতে করি মনে পাসরা না যায় গো
কি করিব কি হবে উপায়
কহে দ্বিজ চণ্ডীদাসে কুলবতী কুল নাশে
আপনার যৌবন যাচায়।”
চণ্ডীদাসের পদাবলীতে রাধার এই নিবিড় বেদনার একতারা রাগিনী বেজে উঠেছে। শ্যামের জন্য তার প্রতীক্ষা নিত্যকালের। অথচ রাধার এই চিত্রটি ফোটাতে কবি আলংকারিক চাতুর্য, ছন্দ ও শব্দের মনোহারিত্ব দিয়ে কাব্য কৌশল প্রদর্শন করেননি। কবি তাঁর পূর্বরাগের রাধাকে এমন একটি তপস্যার মূর্তিতে স্থাপন করেছেন যার জীবন বৈরাগ্যে কোন রুক্ষতা নেই, আছে শুধু ভালোবাসার রাঙা আলপনা। প্রেম সাধনায় রাধা দুঃখ সহার তপস্যার মধ্যে ভূমানন্দের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। জীবনের শ্রেয়কে পাওয়ার এই সাধনা যে কত বেদনার ডালি মাথায় নিয়ে আত্মত্যাগের দুঃসহ পথে এগিয়ে চলে সেটাই রাধা বুঝিয়েছেন।
কোন কোন সমালোচক চণ্ডীদাসের এই কবিতাতেও দেহবাদের আভাস পেয়েছেন। কিন্তু মনে হয় যে অঙ্গস্পর্শের কাঙ্খিত সজ্ঞায় রাধা চিন্তিত সে অঙ্গস্পর্শের যাতনা তার দেহে, তার চেয়ে বেশি তার অন্তর্লোকে। পূর্বরাগ পর্যায়ের রাধার এই যে দুঃখ-দুর্গম দুঃশ্চর সাধনার ছবি এঁকেছেন কবি তার সঙ্গে মিল আছে কুমারসম্ভবের চন্দ্রশেখরের সাধনায় উমার ছবিটি। মিল আছে দুষ্মন্তের জন্য শকুন্তলার বেদনা ব্যাকুল প্রতীক্ষা। চণ্ডীদাসের রাধা সুখের জন্য উৎকণ্ঠা। সেই সুখ হচ্ছে –
মানব সংসারে সদ্যজাত ভালোবাসার গভীর আবেগ আরও বেশি ঘনত্ব লাভ করে দুঃখের অগ্নিতাপে। চণ্ডীদাস তাঁর রাধার প্রেমকে পুড়িয়ে উজ্জ্বল হেম করে তুলেছেন। এত অতলান্ত বেদনার এত আকর্ষণীয় মাধুর্য এই পর্যায়ের কোনও কবিই সৃষ্টি করতে পারেননি। শেলি বলেছিলেন আমাদের Saddest thought মুক্তির পথ পায় আমাদেরই Sweetest song-এ। চণ্ডীদাসের রাধাও তার দুঃখ-বিধুর অন্তরের বাণী পাঠকের দরবারে পৌঁছে দিয়ে অনাস্বাদিতপূর্ব প্রেম মাধুর্যে কলাবতী রাগিনী সৃষ্টি করেছেন। আর তাতেই কবির অনন্য কৃতিত্ব।
👉👉 আমরা যথারীতি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করছি উপরে আমরা আলোচনা করলাম পূর্বরাগ কি পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে। প্রশ্নটিই আপনার প্রয়োজন অনুসারে এবং নম্বর অনুসারে ছোট বড় করে লিখতে পারেন। যদি আপনার নোট টি ভালো লেগে থাকে তবে অবশ্যই বন্ধুদের শেয়ার করুন ও কমেন্ট করে জানাবেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের এই সকল প্রশ্ন গুলি দেখতে পারেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন