অভিসার কি ? বৈষ্ণব পদাবলীতে অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করো - pdf

    বৈষ্ণব পদাবলীতে অভিসার রসাত্মক একটি পর্ব। বৈষ্ণব পদাবলীতে ভক্তের প্রতি ভগবান বা ভগবানের প্রতি ভক্তের এক অভিসার যাত্রা বর্ণিত হয়েছে অভিসার পর্বে। তাই অনেকের মতে অভিসার বৈষ্ণব পদাবলীর প্রাণ। এখানে বৈষ্ণব পদাবলীতে অভিসার কি অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। প্রয়োজন ও নম্বরের ভিত্তিতে এই নোট টি আপনি ছোট ও বড় করে লিখতে পারেন। 



অভিসার কি ? 


অভিসার শব্দের অর্থ সংকেত স্থানে গমন। অভিসার শব্দটি সাধারণভাবে মানুষের উদ্দিষ্ট স্থানের অভিমুখে যাত্রার কথা বোঝাত। কিন্তু ক্রমশ এটি প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের উদ্দেশ্যে পরস্পরের অভিমুখে যাত্রাকেই বোঝাতে থাকে। শ্রীরূপগোস্বামী ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে লিখছেন –


“যাভিসারয়তে কান্তং স্বয়ং ব্যভিসরত্যপি।
সা জ্যোৎস্না তামসী যান যোগ্যাবেশাভিসারিকা।।”

অভিসার কি ? বৈষ্ণব পদাবলীতে অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি
Educostudy.in/অভিসার 

উজ্জ্বলচন্দ্রিকায় এর অনুবাদে বলা হয়েছে –



“অভিসার করায় কান্তে, নিজে অভিসরে।
জ্যোৎস্না তমোযোগ্যা বেশ অভিসার ধরে।।”


দুর্বার, দারুণ মদনানলে উত্তপ্তা অত্যন্ত আকুল মনে নিঃশঙ্কভাবে যে নায়িকা প্রিয়ের সাথে মিলিত হবার জন্য যাত্রা করেন তাকেই অভিসারিকা বলা হয়। ‘রসকল্পবল্লী’-তে অভিসারিকা সম্বন্ধে বলা হয়েছে –


“কান্তার্যিনী তুখা যাতি সংকেতং অভিসারিকা।”


রসকল্পবল্লীতে নিকুঞ্জকানন, উদ্যান, জলশূন্য পরিখা, অট্টালিকার গবাক্ষ, নদীতীরের কন্টকযুক্ত বাঁধ, গৃহের পেছনের অংশ এবং ভাঙা মঠ এবং মন্দিরকে অভিসারের সংকেত স্থান হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। অভিসার পর্যায়ের বিশেষত্ব প্রকৃতি এখানে রাধা-কৃষ্ণের মিলনের পথে প্রতিকূল ভূমিকাই গ্রহণ করেছে।


  সেই প্রতিকূলতার কষ্টিপাথরে যাচাই হয়েছে রাধা নিকষিত হেমতূল্য কৃষ্ণপ্রেম। এই রাধা বিঘ্ন বিজয়িনী, অধ্যাত্ম পথযাত্রী। তার এই অভিসারে অনেকে জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন হওয়ার জন্য দুর্গম গিরি, কান্তার মরু অতিক্রম করার কথা বলেছেন। কিন্তু পদাবলী সাহিত্যে রাধা কখনই কৃষ্ণের জীবাত্মার প্রতীক নয়। হ্লাদিনী শক্তির স্বরূপা



অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি


 অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ অবিসংবাদী কবি গোবিন্দদাস। অভিসারের মধ্যে যে বিপুল গভীর আবেগ, অতন্দ্র নিষ্ঠা, দুরূহকে, দুর্গমকে সুগম করার নিষ্ঠা, গোবিন্দদাসের অভিসার বিষয়ক পদে তার পরিপূর্ণ প্রকাশ। তার পদের চমৎকারিত্বের কারণ কবির নিজ প্রতিভা ধর্ম – তাঁর চলিষ্ণুতা, চিত্র রসরসিকতা ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতা রস। কবি নিজ মর্মকাব্যের রূপনির্মাণে শক্তি দিয়েছেন এবং চৈতন্যজীবনের অপূর্ব অভিজ্ঞতা সেই শক্তিকে সার্থকতার পথ প্রদর্শন করেছে।


অভিসারের কল্পনা কিছু মৌলিক নয়। সৃষ্টির প্রাক লগ্ন থেকে বিবর্তনের পথে মানব জীবনের অগ্রগতির সাথে অভিসারের কল্পনার এত ঘনিষ্ঠতা যে, যা কিছু কৃচ্ছসাধনায় লভ্য, সংগ্রামে অঙ্গীকার্য, তাই অভিসার-জীবনাভিসার। মানব জীবনের দুই গতি – এক, অসীম অতীত হতে অনন্ত ভবিষ্যতের অভিমুখে পথ পরিক্রমা; অন্যটি সেই পথ চলতে চলতে আত্মপ্রেম-স্বীয় কামনা বাসনার চতুর্দিকে চক্রমন। মানবীয় প্রেমের জন্য তেমনই স্ব বৃত্তগতি বহু পূর্বকালেই অভিসার আখ্যা পেয়েছে।


রাধা অভিসারে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এই অভিসার অধ্যাশ্রয়ী, আসন্ন সাধনায় সিদ্ধিলাভের উপযোগী হওয়ার অভ্যাসযোগ, দেহে-মনে সামর্থ্য সংগ্রহের প্রস্তুতি অধ্যায় –


“কন্টকগাড়ি 		কমলসমপদতল
মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি।
গাগরি বারি 		ঢারি করি পিছল
চলতহি অঙ্গুলী চাপি।।”

কেবল জল ঢেলে কাঁটা মাড়িয়ে সাধনা নয়, যেখানে সর্বাধিক ভীতি ও সর্বাধিক প্রীতি সেই দ্বৈতকেই জয় করতে হবে, তবেই সে পাবে দয়িত কৃষ্ণকে। পথে আছে সাপের ভয় তাই নিজের কঙ্কণ মূল্য দিয়ে সাপের মুখ বাঁধার কৌশল শিক্ষা করেন –


“করকঙ্কণ পণ 	ফণীমুখ বন্ধন
শিখই ভুজগ গুরু পাশে।”

কতদূর দুর্গম পথ সিদ্ধি কত কঠিন, বিঘ্ন-বিপদ, বাধা-বন্ধ, কত সুদুস্তর কবি তা স্মরণ করতে পারেন না। শুধু সমাজ সংসার নয়, বিশ্ব-প্রকৃতিও তার উপর বিরূপ। গোবিন্দদাস অভিসারিকা রাধার সামনে পরিব্যাপ্ত বিশ্ব-প্রকৃতির ছবি আঁকছেন। শব্দমন্ত্র, ধ্বনিগুণ, ভাবগৌরব মিলেমিশে সে বর্ণনা অনির্বচনীয় স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে।


বর্ষাভিসারেই নির্দিষ্ট থাকে অভিসারিকা রাধার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। প্রকৃতির প্রতিকূলতা তখন সবচেয়ে তীব্র। মেঘগর্জন মুখরিত রাত্রির ঘন আঁধারে যখন নিজের শরীরই দেখা যায় না সেই সময় রাধার মনে অভিসারের বাসনা জাগে। শুধু তাই নয়, এই প্রতিকূল পরিবেশকেই রাধা অভিসারের উপযুক্ত মুহূর্ত বলে ভেবেছেন। এই যাত্রার সময় প্রতিকূল প্রাকৃতিক অবস্থার সম্পর্কে রাধা বলছেন –


“একে কুলকামিনী 	তাহে কুহুযামিনী
ঘোর গহন অতিদূর।
আর তাহে জলধর 	বরি খয়ে ঝর ঝর
হাম যাওব কোন পুর।।”

গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের মহাভাবময়ী রাধার চিত্র গোবিন্দদাস আঁকেননি। এক প্রেমিকা নারীর প্রেম গৌরবকে তুলে ধরেছেন। প্রেমের দেবতা যাকে কোটি-কোটি মদনবাণ বর্ষণ করেছেন, মেঘের দেবতা যাকে স্পর্শ করতে পারে না, প্রেমানল যার হৃদয়ে অহর্নিশ জ্বলছে, বজ্রাগ্নি তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তাই নবকলিকার মত রাধা কৃষ্ণের কাছে সমর্পিত প্রাণ –


“তুয়া দরশনে আশে 	কিছু নাহি জানলুঁ
চিরদুখ অব দূরে গেল।”

প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন 

তাই কৃষ্ণ-প্রেম পাগলিনী রাধা শরীর ত্যাগ করতে কুণ্ঠিত হবেন না। গোবিন্দদাসের পদে বিঘ্ন-বিজয়িনী রাধার প্রেম তপস্যার চূড়ান্ত চিত্রণ প্রতিভাত হয়েছে। রাধা বলছে –


“তোহেরি মুরলী যব 	শ্রবণে প্রবেশল
ছোড়লুঁ গৃহসুখ আশ।”

গোবিন্দদাসের অভিসারের মধ্যে আছে একটা অনিবার্য প্রাণাবেগ, সুদুর্জয় আত্মবিশ্বাস, অতন্দ্র সাধন দীপ্তি। অপরিসীম উৎকণ্ঠার যন্ত্রণাময় আকুতি তা শুধু প্রেমের লীলা বৈচিত্র্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, তা কেবল আহ্নিক আত্মপরিক্রমা নয়-সৌরাবর্তনের গতিবেগও বর্তমান। বৈষ্ণব লীলাবাদী কবি গোবিন্দদাস কোথাও থামেননি। চলতে চলতে তিনি কৃষ্ণকে সন্ধান করেন। রাধার ভগবানও দাঁড়িয়ে নেই। তিনি বাঁশি বাজিয়ে এগিয়ে আসছেন। ভক্তের আকর্ষণে ভগবান তার কাছে গিয়ে পড়েন। অলক্ষিত কৃষ্ণের আকর্ষণে ধরা দিয়ে পথ চলার ইতিহাস অভিসারেরই মূল কথা। গোবিন্দদাস তারই দ্রষ্টা ও স্রষ্টা।


👉👉   বাংলা সাহিত্যের অনান্য পর্বের মত বৈষ্ণব পদাবলী থেকে পরপর যে প্রশ্নগুলি লেখা হচ্ছে তার মধ্যে আজ এখানে অভিসার কি ও ও বৈষ্ণব পদাবলীতে অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হলো। যদি প্রশ্ন টি আপনার প্রয়োজনে লেগে থাকে ও পরে আপনার ভালো লেগে থাকে অবশ্যই বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করুন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অনান্য প্রশ্ন গুলি এখান থেকে দেখে নিতে পারেন।