চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কালকেতু (Kalketu) চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা - pdf

    বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র কলকেতু ( Kalketu ), নিয়ে আজ আমরা এখানে আলোচনা করবো। এর আগে আমরা ভারু দত্তমুরারী শীল চরিত্র নিয়ে আলোচনা করেছি, বাংলা সাহিত্যে এই সকল চরিত্র নিয়ে আলোচনা খুব গুরত্বপূর্ণ, তাই এখানে তা আলোচনা করা হলো।


কালকেতু চরিত্র


“নীচ কুলে বাস অতি জাতিতে চোয়াড়।
কেহ না পরশ করে লোকে বলে রাঢ়।।”


মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ – এর আখেটিক খণ্ডের নায়ক কালকেতুর এই হল পরিচয় ও পটভূমি। মুকুন্দরামের কবিত্বের সামনে চরিত্র নির্মাণ কয়েকটি সমস্যা নিয়ে দেখা দিয়েছিল। কবি কল্পনার রঙ চড়ানোয় দক্ষ ছিলেন না বলেই চরিত্র নির্মাণে এই সমস্যাগুলি দূর করতে পারেননি।


 কালকেতুর চরিত্র তাই কবির অসামান্য শিল্প সৃষ্টির নিদর্শন নয়। আসলে কবির সামনে একটি দ্বন্দ্ব ছিল এই চরিত্রটি নির্মাণের সময়। মূলত সে শাপভ্রষ্ট দেবপুত্র। পৌরাণিক শক্তিসত্তা আর বীর্যবত্তা তার সহজাত অথচ মূল কাহিনীর অনুষঙ্গ ধরে তাঁকে রাখতে হয়েছে অন্ত্যজ শ্রেণীর সামাজিক বলয়ে।


 তাদের জীবনচর্চা, আচরণ স্বাভাবিক ভাবেই এই চরিত্রটির মধ্যে মিশে গেছে। অথচ সেই প্রচণ্ড শক্তি আর দেবানুগ্রহলাভের সৌভাগ্য তার চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য।


কালকেতু (Kalketu) চরিত্র
Edicostudy.In/Kalketu



বালক কালকেতুর রূপ বর্ণনায় কবি নিজেই কিছুটা দো-টানায় ছিলেন। একটি ব্যাধনন্দনের সৌন্দর্য, গতি-প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে ঐতিহ্য মণ্ডিত সংস্কৃত রস সাহিত্যের দারস্থ হবেন নাকি অভিজ্ঞতা তাঁর সহায় হবে। এই দ্বিধার জন্যই একবার লিখলেন –


মাতঙ্গ জিনিয়া গতি 	রূপে যিনি রতি পতি
সবার লোচন-সুখ-হেতু।

আরো লিখলেন –


কপাট-বিশাল বুক 	নিন্দি ইন্দীবর মুখ
আকর্ণ দীঘল বিলোচল।

মনে হয় এরকম অভিজাত বর্ণনায় কবি নিজেই তৃপ্তি পাননি। তাই এরই পাশে তাঁকে লিখতে হয়েছে –


বিচিত্র কপালতটি 	গলায় জলের কাঁঠী
করযুগে লোহার শিকলী

এবং –


দুই চক্ষু যেন নাটা 	 ঘুরে যেন কুচ ভাটা
কানে শোভে স্ফটিক কুণ্ডল।

এই দ্বিতীয় পর্যায়ের বর্ণনাতেই আসক কালকেতু এবং তার দক্ষ স্রষ্টার আর্বিভাব। বর্ণনার আভিজাত্য গ্রাম্যতার পাশে ম্লান হয়ে গেছে। কিন্তু সেই ম্লানিমাতে শিল্পীর মহিমা প্রকাশিত হয়েছে। কালকেতু আদিম ব্যাধ সমাজের প্রতিভূ।


 শিক্ষাহীন, সংস্কার শূন্য জৈব তাড়নায় অমিত বিক্রম যে জীবন ধারা সেইকালে গ্রাম্যপল্লীর প্রান্তিক জীবনরূপে প্রবাহিত হয়ে চলেছিল তার সংগে কবির সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেছিল বলেই কালকেতুর বীরত্বে শারীরিক শক্তির বর্বর নৃশংসতা এসে মিশেছে। তার ভোজন বর্ণনায় ভোজন সামগ্রীর অপরিমিতি শুধু নয় লেগে আছে ভোজন প্রকৃতির আদিমতা। কবি তাই যখন লিখলেন –


একশ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে।।
একশ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে।।
চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ।
ছয় হাণ্ডি মুসুরী সুপ মিশ্যা তথি লাউ।।


নাগরিক রুচি সম্মত আহার ব্যবস্থার মধ্যে এ ছবি বিকট, হাস্যকর এবং অসম্ভব। কিন্তু ঐ ক্ষুধালগ্ন দেহবোধ সর্বস্ব জীবনধারায় এ কোনো অমানুষিক ভোজন দৃশ্য নয়, বরং ব্যাধ জীবনের সহজ স্বাভাবিকতা। কিন্তু সমস্যাটা হলেন কবি স্বয়ং। এই বর্ণনা দিয়েই বোধ হয় তাঁর মনে হল রুচিসম্মত কথা বলা হয়নি। তাই কনো অদৃশ্য সব্যতায় কৃত্রিমতায় অভ্যস্ত পাঠকের বিরক্তি কবি নিজেই প্রকাশ করে দিলেন –


শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিটকাল।
ছোটগ্রাস তোলে যেন তে আঁটিয়া তাল।।


এই আদিম জীবনাভ্যাস ও সংস্কৃতি প্রকাশ পেয়েছে ফুল্লরার সঙ্গে কথোপকথনে। দীর্ঘকাল দরিদ্র হলেও সে দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েছিল এই ব্যাধ দম্পতি। হঠাৎ করেই ষোড়শী কন্যা বেশিনী দেবী চণ্ডীর আবির্ভাবে ফুল্লরার সংসারে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে ব্যাধ –


শাশুড়ী ননদী নাহি নাহি তোর সতা।
কার সনে দ্বন্দ্ব করি চক্ষু কৈলি রাতা।।


এই অনার্য ক্ষিপ্ততাতেই সে বলেছে –


ব্যক্ত করি রামা মোর কহ সত্য ভাষা।
মিথ্যা হইলে চিয়াড়ে কাটিব তোর নাসা।


এই হল কালকেতু চরিত্রের স্বাভাবিক অন্তর্জাগতিক ভাষা। অবশেষে দেবীর কৃপায় ধনলাভ হও তার। ভক্তের বোঝা বহন করে দেবী ধন ঘড়া কাঁখে নিয়ে চলেছেন কালকেতুর পিছনে পিছনে অদ্ভুত কালকেতু এইসময় বিশ্বাস করতে পারেননি দেবী চণ্ডিকাকে –


পশ্চাতে চণ্ডিকা যাব আগে কালু যায়।
ফিরি ফিরি কালকেতু পাছু পানে চায়।।
মনে মনে কালকেতু করেন যুকতি।
ধনঘড়া নিয়া পাছে পালায় পার্বতী।।


কালকেতু সামান্য ব্যাধ, ধনের অভিজ্ঞতা তার নেই। ধন-দাত্রী দেবীর প্রতি এই অবিশ্বাস তাই চির দরিদ্র ব্যাধ জীবনের সরল স্বাভাবিক প্রকাশ।


কিন্তু এই ব্যাধ জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের মধ্যে কালকেতু যখন কবি ধনপ্রাপ্তির সৌভাগ্যে রাজা করে তুললেন। ধীরে ধীরে তখনই চরিত্রে অস্বাভাবিক কৃত্রিমতা যুক্ত হল। পর্যবেক্ষনের শক্তি যার প্রবল কল্পনার জোর ছিল তার খুবই কম। শিল্পে তাই দারিদ্র্য দেখা গেল।


 কালকেতু অঙ্গুরীর মূল্য নিয়ে ধূর্ত মুরারির সঙ্গে জোর তর্ক করেছে। রাজা হিসাবে সকল প্রজাকে গুজরাটে বসবাসের জন্য প্রজাকল্যাণকামী ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়ে আলাপ করেছে। অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন একটি মানুষের মানসিক, বৌদ্ধিক পরিবর্তনকে এত দ্রুত সূচিত করতে পারে কিনা তা নিয়ে কবি চিন্তাই করেননি।


 এ ধরনের অবিশ্বাস্য অসম্ভাব্যতায় চরিত্রটি বিক্ষিপ্ত হয়েছে। ভাঁড়ু এল অবশেষে। তার ছলনার কাছে কালকেতুকে হারতেই হল। তারই ষড়যন্ত্রে কলিঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধল কালকেতুর। এত বড় বীর, অথচ গৃহবধূর বুদ্ধিহীন পরামর্শে ধানের ঘরে গিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে। কলিঙ্গ রাজের কাছে বন্দী কালকেতুর যে ক্ষেদোক্তি সেখানে তার আসল চরিত্রটি ফুটেছে-


মাংস বেচি ছিনু ভালো 	এবে যে পরাণ গেল
বিবাদ সাধিল কাত্যায়নী।

ঠিকই বলেছে কালকেতু। ব্যাধ বৃত্তিতে দারিদ্র্য ছিল, ছিল আদিম বর্বরতা। তবু ছিল শান্তি, ছিল আরণ্যক স্বাধীনতা, ছিল ফুল্লরার ভালোবাসা, রাজৈশ্বর্য ভোগ সেই নিরুপদ্রব জীবনকে করেছে সদাশঙ্কিত।


রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন কালকেতু এক বিকৃত বৃহৎ স্থানুমাত্র। তা কিন্তু কখনই নয়। কালকেতুর মধ্যেও জীবনের এক সরল প্রগতির চিত্র ধরা আছে। আমাদের এই সভ্য গৃহের গরাদ দেওয়া বাতায়নের শ্বাসরোধকারী অচলায়তন থেকে দূরে এক প্রান্তিক জন-জীবনের ইতর কাকলী সবটুকু মলিনতা, স্থূল ধূলি অবলেপ, মাতৃঅঙ্গে ধূলিধুসরিত শিশুর মতো অতি নিঃসংকোচে এই ব্যাধ জীবন ধারার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।


 এ চরিত্রে সামঞ্জস্যের অভাব আছে। তবু সে আমাদের মনে করিয়ে দেয় আদিম বর্বর ধীরোদাত্ত জীবনের মধ্যে এক অনাড়ম্বর প্রীতি ছিল। এক অকপট সহজতা ছিল, হোক না তা অভাবক্লিষ্ট। সে অভাব কেবল শরীরের, মনের নয়। দেহবোধ সর্বস্ব সেই আদিম জনগোষ্ঠি ও এভাবেই প্রমাণ করেছে দেহ বোধের চেয়ে মানুষের আনন্দে গড়া নীড় কত মূল্যবান, কত মহিমময়।

👉👉   এখানে আমরা চন্ডীমঙ্গল কাব্যর উল্লেখযোগ্য চরিত্র কাল কেতু সম্পর্কে আলোচনা করলাম, এছাড়া ও বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রশ্ন গুলি এখানে আলোচনা করা হয়েছে।।