চন্ডীমঙ্গল কাব্যের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ফুল্লরা ( Fullora ) সম্পর্কে আলোচনা - pdf

    চন্ডীমঙ্গল কাব্যের একটি প্রধান চরিত্র ফুল্লরা ( Fullora ), কবি স্বর্গ বিতাড়িত একটি চরিত্র কে মর্ত্যের মানবী রূপে অঙ্কন করেছেন। চন্ডীমঙ্গল কাব্যের এই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র টি সম্পর্কে আজ আমরা এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। 


ফুল্লরা

অর্থলিপ্সা, স্বপত্নী বিদ্বেষ তথা স্বামী প্রেমের নিরঙ্কুশ অধিকার, পুরাণজ্ঞান, লোকভিজ্ঞতা এবং সেই সঙ্গে ব্রীড়াশীলা, কর্মনিপুণা ও জীবনের নানাবিধ অভাবের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামী চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খণ্ডের নায়িকা, সঞ্জয়কেতুর কন্যা, কালকেতুর পত্নী ফুল্লরা। সুখ-দুঃখের দোদুল্যমান তরঙ্গে সে ভাসমান। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঘূর্ণাবর্তে সে পাক খেয়ে চলেছে অবিরত। সক্রিয়তা ও সজীবতায় সে অগ্রণী। রবীন্দ্রনাথের মানস চক্ষেও তার এই জঙ্গমতা এড়িয়ে যায়নি, তাই তিনি বলেছেন –


“কবিকঙ্কণ চণ্ডীর সুবৃহৎ সমভূমির মধ্যে কেবল ফুল্লরা ও খুল্লনা একটু নড়িয়া চড়িয়া বেড়ায় –”


প্রাক্‌বিবাহপর্বে ফুল্লরার পিতা সঞ্জয়কেতুর মুখে বর্ণিত হয়েছে তার কন্যার গুণাবলী –


এই কন্যা রূপে গুণে নামেতে ফুল্লরা।
কিনিতে বেচিতে ভাল জানয়ে পসরা।।
রন্ধন করিতে ভাল এ কন্যা জানে।
যত বন্ধু আইসে তারা কন্যাকে বাখ্যানে।।


বিবাহ পরবর্তী জীবনে সে কালকেতুর যোগ্য পত্নী বা ‘হাঁড়ির মুখের সরা’ রূপে আবির্ভূত হয়। ফুল্লরা সর্বংসহা ধরিত্রীর মত সহনশীল হলেও দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কুঠারাঘাতে তার অন্তর্নিহিত নারীসত্তা যন্ত্রণার্ত হয়েছে। তাই সে নিজের মন্দভাগ্যের ধিক্কার দিয়ে বলে উঠেছে –


দারুণ দৈবের গতি 	কপালে দরিদ্র পতি
ঠেকিনু সম্বল চিন্তা ফাঁদে।
অন্নবস্ত্র নাহি ঘরে 	বিভা দিল হেন বরে
কর্ণবেধ জাতি ব্যবহারে।।

প্রকৃতার্থে সংসারের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ আর স্বামীর প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসার সৌজন্যেই সে এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনযাত্রাকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু পতি প্রেমের সেই স্বর্গরাজ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীর আগমন ঘটেছে তখনই অনাগত ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্ন চিন্তায় সে শঙ্কিত হয়ে উঠেছে।

গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ফুল্লরা ( Fullora ) সম্পর্কে আলোচনা
Educostudy.in/Fullora 


 প্রকৃতিতে সে বন্যা নারী, কিন্তু সামজিক রমনীর মত সংস্কার তার রক্তে। স্বামীর ভালোবাসাকে সে ভাগ করে নিতে রাজি নয়। তাই ছদ্মবেশিনী চণ্ডীকে শাস্ত্রীয় পরামর্শ দান করেছে –


স্বামী বনিতার পতি 	স্বামী বনিতার গতি
স্বামী বনিতার সে বিধাতা।
স্বামী যে পরম ধন 	স্বামী বিনে অন্যজন
কেহ নহে সুখ মোক্ষদাতা।

কিন্তু শাস্ত্রীয় উপদেশে যে আসন্ন সমস্যার সমাধান হবে না একথা উপলব্ধি করে ফুল্লরা শাস্ত্র ছেড়ে নেমে এসেছে কঠোর বাস্তবের রুক্ষভূমিতে –


সতিনী কোন্দল করে 	দ্বিগুণ বলিবে তারে
অভিমানে ঘর ছাড় কেনি।
কোপে কৈলে বিষপ্রাণ 	আপনি তাজিবে প্রাণ
সতীনের কিবা হবে জানি।।

ফুল্লরা পাপ-পুণ্য বোঝে, বোঝে নারীর অধিকার, অনধিকার। কিন্তু সবার আগে বোঝে নিজের স্বার্থ, নিজের দুঃখ বিলাস বৈভবতা। তাই চণ্ডীকে দুঃখের কথা জানিয়ে সংসার থেকে হটিয়ে দেবার প্রবল বাসনা তার। সেই বাসনার বহ্নিদহনে ব্যক্ত হয়েছে মধুমাসে নারীর জৈবিক কামনার অচরিতার্থতা –


বনিতা পুরুষ যত পীড়োনে মদনে।
ফুল্লরার অঙ্গ পোড়ে উদর দহনে।।


অথবা চৈত্রের খাদ্যাভাব ও প্রবল অর্থভাব –


অনল সমান পোড়ে চৈতের খরা।
চালুসেরে বাঁধা দিনু মাটিয়া পাথরা।।


দুঃখের এই দীর্ঘ তালিকাতে দুঃখের রেশ থাকলেও তার থেকে বড় হয়ে উঠেছে ফুল্লরার অন্তগূঢ় মানসিক Tension । তার সুখের সংসার, তার শান্তির নীড় ভেঙে যাওয়ার দুঃসহ দিঃস্বপ্ন তাকে অস্থিরতার জটিল ঘূর্নাবর্তে পাক খাইয়েছে প্রতিনিয়ত। অসহনীয় বেদনার ভারে ভারাক্রান্ত ব্যাধ গৃহিনী অবশেষে ছুটে গেছে গোলাহাটে কালকেতুর কাছে। সন্দেহে, ক্ষোভে, অভিমানে এবং নিরতিশয় যন্ত্রনায় সে অভিযোগ করেছে –


কি লাগিয়া প্রভু তুমি পাপে দিলা মন।
যেই পাপে নষ্ট হৈলা লঙ্কার রাবণ।।
পিপীষার পাখা ওঠে মরিবার তরে।
কাহার ষোড়শী কন্যা আনিয়াছ ঘরে।।


এরপর ধনপ্রাপ্তিতে লোভী গ্রাম্য রমনীর লালসাতুর চেহারাটা নিমেষে যেন বেরিয়ে এল নিস্তরঙ্গ ব্যাধ পল্লীর সহজ সরল আবরণ ভেদ করে। দারিদ্র্য ঘোচানোর জন্য দেবী চণ্ডী কেবলমাত্র একটি অঙ্গুরী দিতে চাইলে লোভী ও বুদ্ধিমতী ফুল্লরা স্বামীকে নিষেধ করে বলে –


একটি অঙ্গুরী নিলে হবে কোন কাম।
সারিতে নারিবে প্রভু ধর্মের দুর্নাম।।


এরপর ফুল্লরা নিজের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে কলিঙ্গরাজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধরত কালকেতুকে বীরাঙ্গনা সুলভ মনোভাবের পরিচয় না দিয়ে ধান্যঘরে আত্মগোপনের পরামর্শ দিয়েছে। অবশেষে ভাঁড়ু আবিষ্কার করেছে সে গুপ্ত স্থান।, বন্দী হয়েছে কালকেতু। স্বামীর প্রতি নিবিড় ভালোবাসার টানে বন্দী কালকেতুর মুক্তির জন্য কাতর মিনতি জানিয়েছে কোটালের কাছে –


গো মহিষ ধান্য লেহ অমূল্য ভাণ্ডার।
নফর করিয়া রাখ স্বামীরে আমার।।


স্বামীর জীবন নাশের আশঙ্কায় ফুল্লরার এই প্রতিক্রিয়ায়, চিরন্তন এক নারীকে খুঁজে পাই আমরা, যে সেই দারিদ্র্য দুঃখময় স্বাধীন সঙ্গার জীবনই ফিরে পেতে চায়, চলে যেতে চায় মুক্ত অরণ্যের মাঝে। তাই কোটালের কাছে সে বলেছে –


কুলিতার ধনু দেহ গোটা তিন খান।
মাটিয়া পাথরা আর পুরাণ খুঞা খান।।


এরমধ্যে কালকেতুর জন্য ফুল্লরার তীব্র হৃদয়াকুতি যেমন ধরা পরেছে, তেমনি শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পায় অর্থবিত্ত প্রতিপত্তিময় উত্তেজনায় – উত্থান পতনে ভরা জীবনের পরিবর্তে দারিদ্র্যদীর্ণ দুঃখময় হলেও শান্ত স্নিগ্ধ নিশ্চিন্ত গার্হস্থ্য জীবনের জন্য অতি সাধারণ মানুষের অনন্য আকাঙ্ক্ষা।


 প্রকৃত পক্ষে কবি মুকুন্দ ফুল্লরার মধ্যে দিয়েই সুস্থ গার্হস্ত্য জীবনের জয়গান গেয়েছেন। কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের পর্যবেক্ষণের দুটি শক্ত পা ছিল বলেই প্রত্যন্ত জীবনের সমস্ত অলিগলিতে, আনাচ-কানাচে ভ্রমণ করে তুলে এনেছেন সমাজ বাস্তবতাকে।


 পারিবারিক জীবনবৃত্তে সুখ;দুঃখের তরঙ্গভঙ্গে নিত্য দোদুল্যমান রমনীকে সীমাস্বর্গের ইন্দ্রানীতে পরিণত করার যে আত্যান্তিক প্রয়াস ছিল মুকুন্দরামের ফুল্লরা চরিত্রে তা স্বতন্ত্র অভিজাত নিয়ে দেখা দিয়েছে। ফুল্লরা চরিত্রটিও তাই কবির পূতকরস্পর্শে সার্থকতার অভ্রংলিহ প্রদেশে উন্নীত হয়েছে।

👉👉   মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দ রাম চক্রবর্তী, তার সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র ফুল্লরা নিয়ে এখানে আমরা আলোচনা করেছি। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য প্রশ্ন গুলি পেতে উপরে দেওয়া লিংক টি তে ক্লিক করতে পারো, ধন্যবাদ।।