বৈষ্ণব পদাবলীর আক্ষেপানুরাগ কি ? আক্ষেপ অনুরাগ এর শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করো - pdf

   বৈষ্ণব পদাবলীর রস পর্যায়ের মধ্যে অতি উল্লেখযোগ্য একটি পর্ব হল আক্ষেপানুরাগ। কারণ যেখানে প্রেম আছে সেখানে আক্ষেপ হৃদয় থেকে উত্থিত হবে তাতে আর ব্যতিক্রম কিসের। তাই বৈষ্ণব পদাবলীতে আক্ষেপানুরাগ ও আক্ষেপ অনুরাগ এর শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে এখানে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো ।



বৈষ্ণব পদাবলীতে আক্ষেপ অনুরাগ কি ? 


    গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন অনুযায়ী সচ্চিদানন্দ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সৎ, চিদ্‌ ও আনন্দ- এই তিনটি শক্তির সমাহার। তিনি অখিল রসামৃতসিন্ধু বলেই লীলাময়। এই লীলার প্রয়োজনেই তিনি তাঁর হ্লাদিনী শক্তিকে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন করেন। বিচ্ছিন্ন সেই হ্লাদিনী শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ শ্রীমতী রাধাঠাকুরানী। তাই রাধা ও কৃষ্ণ প্রকৃতপক্ষে ভেদাভেদশূন্য-‘একমেদ্বিতীয়ম’। বৈষ্ণবরা মনে করেন রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেমলীলা আসলে নিজের আনন্দশক্তির সঙ্গে পরমাত্মার নিজের লীলা। এই লীলাকে বলা হয় মধুর রসের লীলা। এই মধুর রসের দুটি বিভাগ-


  • বিপ্রলম্ভ
  • সম্ভোগ

সম্ভোগের পাঁচটি বিভাগ-


  • পূর্বরাগ
  • অভিসার
  • মান
  • প্রেমবৈচিত্ত্য
  • প্রবাস

প্রেমবৈচিত্ত্যের আবার চারটি ভাগ-


  • উল্লাসানুরাগ
  • আক্ষেপানুরাগ
  • রূপানুরাগ
  • রসোদ্গার

প্রেমবৈচিত্ত্য এবং আক্ষেপানুরাগ একই বৃন্তের দুটি কুসুম হলেও এদের মধ্যে ভাবের দিক থেকে পার্থক্য আছে। গভীর প্রেমাসক্তির কারণে মনের বৈচিত্র্যময় মানসচেতনার বিভিন্ন দিকের দুর্বলতার প্রকাশই হল প্রেমবৈচিত্ত্য। ‘রসকল্পবল্লী’ তে চমৎকার উপমার সাহায্যে প্রেমবৈচিত্ত্যের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে-


অঞ্চলে বান্ধিয়া রত্ন চাহি ফিরে ফিরে।
কোলেতে থাকিয়া হয় বিচ্ছেদ অন্তরে।।

বৈষ্ণব পদাবলীর আক্ষেপানুরাগ কি ? আক্ষেপ অনুরাগ এর শ্রেষ্ঠ কবি
Educostudy.in/আক্ষেপানুরাগ 

প্রেমবৈচিত্ত্য ক্রমে ক্রমে জন্ম দেয় আক্ষেপানুরাগের। নন্দকিশোর দাস ‘রসকলিকা’ গ্রন্থে আক্ষেপানুরাগের সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে বলেছেন-


অনুরাগের লক্ষণ চারপ্রকার।
উল্লাস, আক্ষেপ, রূপ, অভিসার আর।।


আসলে প্রেম যাতনার অঙ্কুশাঘাতে আহত। মিলনের আনন্দে যত না শরীর রোমাঞ্চিত হয়, বিরহের দ্বিগুন যন্ত্রনায় তা অধিক প্রাণ বিদারক হয়। কৃষ্ণকে কাছে পেয়েও রাধার অন্তরে তাকে হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক মিলনের কালকেও কণ্টকিত করে তোলে। স্বাভাবিকভাবেই প্রেম, প্রেমিক ও প্রেমের প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে রাধার আক্ষেপসহ অভিযোগ প্রকাশ পায়। রূপগোস্বামী এই আক্ষেপের বৈচিত্র্যময় রূপকে আট ভাগে ভাগ করেছেন-


  • শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আক্ষেপ
  • শ্রীকৃষ্ণের বংশীর প্রতি আক্ষেপ
  • নিজের প্রতি আক্ষেপ
  • দূতীর প্রতি আক্ষেপ
  • সখীর প্রতি আক্ষেপ
  • গুরুজনের প্রতি আক্ষেপ
  • প্রমের দেবতা কন্দর্পের প্রতি আক্ষেপ
  • বিধাতার প্রতি আক্ষেপ

প্রকৃতপক্ষে আক্ষেপানুরাগে রাধার আক্ষেপ বা বিলাপের মধ্য দিয়ে তির্যকভাবে অনুরাগ ও প্রিয়কে কাছে পাওয়ার আকুলতা প্রকাশ পায়। তাই কবিরাজ গোস্বামীর মতো এ প্রেম আস্বাদন তপ্ত ইক্ষুর চর্বনের মতো বিরক্তিকর, কিন্তু মধুর। তাই ‘জিহ্বা জ্বলে না যায় ত্যাজন।’

 

আক্ষেপ অনুরাগ এর শ্রেষ্ঠ কবি


আক্ষেপানুরাগের পদে চণ্ডীদাসের প্রতিভা অসামান্য স্ফূর্তিলাভ করেছে। কবি হিসাবে তাঁর ব্যক্তিগত প্রবণতা, বাংলা দেশের গ্রামীন সমাজ এবং তারই সঙ্গে কবির নিজস্ব ধর্মবোধ- সমস্ত কিছুই রূপায়িত হয়েছে আক্ষেপানুরাগের পর্যায়ে। প্রিয় সম্বোধনের একটি পদে রাধার বুকের অর্গল ঠেলে এসেছে নিভৃত বিলাপ-


কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন।।
ঘর কৈনু বাহির বাহির কৈনু ঘর।
পর কৈনু আপন আপন কৈনু পর।।
রাতি কৈনু দিবস দিবস কৈনু রাতি।
বুঝিতে নারিনু বঁধূ তোমার পিরীতি।।


পদটি ক্লান্ত করুণার অপরূপ কবিভাষা। প্রথম দুই ছত্রের মূর্ছাপন্ন অনুযোগের পর রাধিকার প্রেম আত্মপরিচয় পরিচয় দিতে গিয়ে এমন দিব্য শক্তি লাভ করল যার ফলে পরবর্তী চারটি ছত্র উন্নীত হল নিখিল প্রেম সাধনার অমৃতকাব্যে। রাধার প্রেম ঘর ও বাহির, আপন ও পর, দিবস ও রাত্রির ব্যবধান মুছতে পারে।

প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন 

 কিন্তু তার প্রেম নিজেকে মুছতে পারে না। প্রেম সব দেখতে পায়, আপনাকে ছাড়া যেমন ননয়টি সব দেখে নয়নটি ছাড়া। তাই স্বয়ং পিরীতি প্রতিমাও বলে ‘বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি।’ পদটিতে রাধার অসহায়তা ক্ষোভ আর অভিমান নিরাভরণ পংক্তিগুলির সাবলীল প্রবাহে যেন নিষ্ঠুর কৃষ্ণকে আন্দোলিত করার ইচ্ছাতেই তরঙ্গ বিস্তার করেছে। রাধা এখন শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়ান, তাঁর সমব্যথী কেউ নেই। তাই রাধা প্রিয়তমকে কঠিন শাস্তি দিতে চান-


‘মরিব তোমার আগে দাঁড়াইব রও।’


আসলে প্রেমের জন্য রাধার এই যে গঞ্জনা তা তো প্রেমেরই অর্চনা।


অন্যান্য বৈষ্ণব কবি অপেক্ষা চণ্ডীদাস অনেক বেশি মান্য করেছেন লোকগঞ্জনা ও সামাজিক সংস্কারকে। কৃষ্ণপ্রেমের অবাধ্য বহির্মুখী আকর্ষণ আর অন্তঃপুরের পরিজন ভীতি ও প্রথানুগত্য- এই উভয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষত বিক্ষত রাধার চিত্র এঁকেছেন চণ্ডীদাস।


  সমাজ চায় না, গুরুজন নিন্দা করে, ভুবনে কলঙ্ক ঘোষিত হয় তবু প্রেম আনন্দের অক্ষয় উৎস। সংসার মরুতে এই প্রেম ভিতর থেকে নিত্য তৃপ্তির রসসঞ্চার করে। তৃপ্তি এত গাঢ়, কারণ মরুভূমি অমন ভয়ঙ্কর। তাই সমাজ সম্বন্ধে চণ্ডীদাসের আচরণ মৃদু, কুণ্ঠিত ও ভীত। কিন্তু একেবারে অসহ্য সময়ে চণ্ডীদাসের রাধাও সমাজ সিংহের বিরুদ্ধে সশঙ্ক হরিণীর মতো অশ্রুসজল দুঃসাহসী যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।


চণ্ডীদাসের রাধা সর্বইন্দ্রিয়গ্রাসী। গোবিন্দদাসের পদে যেখানে কৃষ্ণেন্দ্রিয়তার পরকাষ্ঠায় রাধিকার পরমোল্লাস, চণ্ডীদাসের রাধা সেখানে অবাধ্য ইন্দ্রিয়ের বিপরীত ব্যবহারে গ্লানি ক্ষুব্ধ-


ধিক রহু এ ছাড় ইন্দ্রিয় মোর সব।
সদা সে কালিয়া কানু হয় অনুভব।।


প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন 

চণ্ডীদাসের রাধার প্রেম বিশুদ্ধ হৃদয়বৃত্তি হলেও হৃদয় দেহধারে ধৃত, সমাজপীঠে স্থাপিত, বিভিন্ন চরিত্র দ্বারা বেষ্টিত। ফলে পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সংঘর্ষে রাধার প্রেম- নৈরাশ্য বর্ণিত। তাই রাধা নবোদ্গত প্রেমের অরুণিমায় প্রেমের ভৈরবী বাজায়, মিলনের দীপ্ত মধ্যাহ্নেও বিরহের বেদনায় শঙ্কিত হয়ে ওঠে।


 চণ্ডীদাসের রাধা একালের রোমাণ্টিক নায়িকা, তার প্রেমে ধরা পড়েছে বিশ্ববিথারী রোমান্টিক প্রেমের মাধুর্য। যে প্রেম অনন্ত কাল মিলনের প্রতীক্ষায় রত, যে প্রেম অনন্ত মিলনের মাঝেও বিচ্ছেদের করুণ রাগিনীতে শংকাতুর, যে প্রেম সমাজের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব মেটাতে অক্ষম হয়ে হৃদয় মথিত বেদনায় হাহাকার করে উঠেছে, সেই বিশ্বজনীন প্রেমের দীপারতি করে চলেছেন রাধা। চণ্ডীদাস তার দ্রষ্টা ও স্রষ্টা।


 👉👉   কৃষ্ণ প্রেমের মাধুর্যে রাধার কাকুতি-মিনতি গুলি বৈষ্ণব পদাবলীর আক্ষেপ অনুরাগ এর পদগুলিতে খুব সুন্দর ভাবে চিত্রিত হয়েছে। আমরা উপরে আক্ষেপানুরাগ কি এবং আক্ষেপ অনুরাগ এর শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। যদি আক্ষেপ অনুরাগ বিষয়টি আপনার ভালো লেগে থাকে তবে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। বাংলা সাহিত্যের অনান্য প্রশ্নগুলি নিচে থেকে দেখতে পারেন -