বৈষ্ণব পদাবলীতে মাথুর কি ? মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করো - pdf

    বৈষ্ণব পদাবলীর মাথুর পর্যায় বৈষ্ণব কবিরা যেভাবে রাধার আত্ম ক্রন্দন আর আত্মনিবেদন বর্ণনা করেছেন তাতে মাথুর পর্যায় টি বৈষ্ণব পদাবলীতে মূল রসের সঞ্চার ঘটিয়েছে। এ পর্যায়ে রাধা কৃষ্ণ বিরহে যেন মত্ত দাদুরী হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে মাথুর কি এবং মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি নিয়ে এখানে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো। 



বৈষ্ণব পদাবলীতে মাথুর কি ? 


   বৈষ্ণব সাহিত্যে ভাবী, ভবন ও ভূত মিলিয়ে যে দূর প্রবাস তাকে মাথুর বলা হয়েছে। পূর্বে মিলিত নায়ক-নায়িকার কেউ যদি অন্যত্র চলে যান, তবে তাঁর অভাবে বিরহ সৃষ্টি হয়। নায়ক-নায়িকার দেশান্তর জনিত ব্যবধানকে প্রাজ্ঞগণ প্রবাস নামে অভিহিত করে থাকেন। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে যাকে প্রবাস বলা হয়েছে, পদাবলী সাহিত্যে তাকেই মাথুর নামে অভিহিত করা হয়েছে। কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলে আর ফিরে না আসার পরিণামে তাঁর সঙ্গে শ্রীমতী রাধার যে চিরবিচ্ছেদ, যার ফলে রাধা এবং কৃষ্ণপ্রাণ গোপীদের অন্তরে বিরহজ্বালা সৃষ্টি হয়েছে, সেই দূর প্রবাসজনিত বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গারের নাম মাথুর।


বৈষ্ণব পদাবলীতে মাথুর পর্যায়ের তত্ত্বগত পরিচয়

মাথুর বিরহ পর্যায়েরই একটি অবস্থা। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে বিপ্রলম্ভের যে চারটি রূপ কল্পনা করা হয়েছে তার শেষতম হল প্রবাস। প্রবাস বিপ্রলম্ভ দু’প্রকারের – নিকট প্রবাস ও দূর প্রবাস। নিকট প্রবাস হল পাঁচপ্রকার-

বৈষ্ণব পদাবলীতে মাথুর কি ? মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করো।
Educostudy/মাথুর


  • কালীয়দমন
  • গোচারণে গমন
  • কার্যানুরোধ
  • স্থানান্তরে গমন
  • রাসের অন্তর্ধান

দূর প্রবাস হল তিন প্রকার-


  • ভাবী
  • ভবন
  • ভূত

ভাবী বিরহে হঠাৎ বিরহ ঘনিয়ে আসছে বলে মনে হয়। আর শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরায় চলে যাচ্ছেন- এই অবস্থা হচ্ছে ভবন বিরহ। শ্রীকৃষ্ণ আসবেন বলে চলে গেছেন কিন্তু নির্দিষ্ট দিন উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও তিনি এলেন না এই অবস্থা ভূত প্রবাস।


অনেকেই মাথুর পর্যারেই এক আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের দিকেও ইঙ্গিত করবার চেষ্টা করেছেন। সেখানে বৃন্দাবন লীলাভূমি, স্বপ্নজগৎ। মথুরা সত্যলোক। তাই জীবন সংগ্রামের বাস্তবক্ষেত্রে প্রত্যেক মানুষের জীবনে মাথুর আসে। সেখানে যৌবনের কর্মভারনত দুঃখ বিধুরতায়, মাথুরের বেদনার অভিজ্ঞতা লাভ হয়। রাধার বিরহ তাই মানুষের চিরন্তন বিরহের কাব্যরূপ। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন-


“আমরা যাহার সহিত মিলিত হইতে চাহি সে আপনার মানস সরোবরের অগম তীরে বাস করিতেছে, সেখানে কেবল কল্পনাকে পাঠানো যায়, সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত হইবার কোন পথ নাই।”


বিরহের আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রেম নিকশিত হেম হয়ে ওঠে- একথা বৈষ্ণব কবিরা বিশ্বাস করতেন। বিরহে নায়িকা সীমাবদ্ধতার গণ্ডী অতিক্রম করে বিশ্বে ব্যপ্ত হয়ে পড়ে-‘ত্রিভুবনমপি তন্ময়ং বিরহে।’ তাই বৈষ্ণব কবিরা রিরহ-ভাবুকতার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন।


মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি

মাথুর পর্যায়ে দুঃখের অতলস্পর্শ রূপ যে পদকারের রচনায় সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে তিনি হলেন বিদ্যাপতিবিদ্যাপতির রাধা-কৃষ্ণ যৌবন সুরার মাদকতাকে মিলনের আনন্দের মধ্যে পরিপূর্ণ উপভোগ করেছেন। তাই তাঁর রাধার হাহাকার সেই পূর্বমিলনের মধুস্মৃতি বিজড়িত আর্তনাদ। চণ্ডীদাস দুঃখের কবি। কিন্তু তাঁর মাথুর বিরহের পদ প্রায় নেই।


  কারণ পূর্বরাগ পর্যায়েই তিনি বিরহকে চরম মাত্রা দান করেছিলেন। পরবর্তীকালে জ্ঞানদাসের মাধুর্য প্রবণতা বিরহের স্বাভাবিক তীব্রতা প্রকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। গোবিন্দদাসের অতিশয় অলংকার প্রীতিও বিরহের মর্মান্তিকতাকে ক্ষুন্ন করেছে অনেকাংশে। অন্যদিকে সুখের কবি বিদ্যাপতির রাধার মিলন সুখের অতীত স্মৃতি, বর্তমান বিরহ দিনগুলির মর্মমূলে একটি বিপর্যয় এনে দিয়েছে। রাধার হৃদয়ের সেই বেদনার হাহাকার প্রকাশিত হয়েছে নিম্নোক্ত পদটিতে-


এ সখী হামারি দুঃখের নাহি ওর
এ ভরা বাদর		মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।

মানব হৃদয়ের একটি বেদনাকে চরম ঐশ্বর্যরূপ দান করবার জন্য বর্ষার দিনটিকে গ্রহণ করেছেন কবি। তিনি লিখছেন-


কান্ত পাহুন 		কাম দারুণ
সঘনে খর শর হন্তিয়া।
মত্ত দাদুরী 		ডাকে দাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া।।

ভাদ্র মাসের এক বৃষ্টি মুখর রাত্রিতে যখন পৃথিবী প্লাবিত, মেঘ গর্জন যখন কাঁপিয়ে তুলেছে দিক্‌বিদিক্‌, আবার তারই মাঝে যখন ময়ূরের উল্লসিত নৃত্য, আনন্দিত ভেকের কলরব, ডাহুকীর ডাক, প্রিয় মিলনের একান্ত মধুর ঐক্যতান রচনা করেছে; তখনি রাধার বিশেষ করে মনে পড়েছে প্রবাসী কান্তের কথা। তখনি তার মনে হয়েছে সকলের মিলনানন্দের এই উৎসব রজনীতে কেবল তারই গৃহ শূন্য। এই নিসঙ্গ হৃদয়ে বেদনা, আবেগ বর্ষা প্রকৃতির যাবতীয় আয়োজনের মধ্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বলা যায় বিরহ প্রেম আর বর্ষা একসঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে যেন অসীমের জানালা খুলে দিয়েছে।


বিদ্যাপতির বিরহ কেবল প্রকাশ্য গৌরবানুভূতিতে সমাপ্ত নয়- তার নিভৃতম রূপও আছে। তাই নবযৌবন বিরহে যাপন করতে হবে ভেবে রাধা বেদনার্ত হয়ে উঠেছেন-


“অঙ্কুর তপন		তাপে যদি জারব
কি করব বারিদ মেহে।
এ নব যৌবন 		বিরহে গোঙায়ব
কি করব সো প্রিয়া লেহে।।”

নিজের যৌবন সম্বন্ধে রাধার এই আত্মবুদ্ধিসম্পন্ন প্রীতিরূপটি অপূর্ব। রাধা বলেছেন বিরহরূপ সূর্যকিরণে তাঁর নব বিকশিত প্রেমাঙ্কুর শুকিয়ে যাওয়ার পর বারিবর্ষণ করে লাভ নেই। রাধার প্রতি কৃষ্ণের এই বিরূপতা যেন চন্দন তরুর সৌরভ ত্যাগ, চাঁদের অগ্নিবর্ষণ আর চিন্তামণি রত্নের নিজ সৌরভ ত্যাগ।


প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন 

 অকুল অনন্ত প্রমত্ত কৃষ্ণ সাগরের কূলে রাধারাণী বসে আছেন। সে সাগর বিরহ সাগর। তার পরপারে কোন সুদূরে তার দয়িত অদৃশ্য হয়ে আছেন, ‘মধ্যে বিচ্ছেদের তরঙ্গিত লবণাম্বুরাশি।’


  কিন্তু রাধার দয়িত কি সমুদ্রের পরপারে, না ঐ সমুদ্রই তিনি। আসলে যিনি অনন্ত তিনিই যে অন্তরতম- তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলন কোনো কালেই সম্ভব হয়নি। অথবা প্রিয়ের মধ্যে অসীমত্বের উপলব্ধির নামই বিরহ। রাধা তাই সেদিন কেঁদেছেন, আজও কাঁদছেন, আগামীকালও কাঁদবেন। ‘এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয় কুটীরে ’- সর্বযুগের সর্বশেষ ও সর্বাধুনিক কথা। পদাবলী তাই অশ্রুর মন্দাকিনী, বেদনার বেদধ্বনি, আনন্দদগ্ধ হৃদয়ের শিখা কাব্য। বিদ্যাপতির কাব্যে এই বেদনা হয়ে উঠেছে রূপময়- অশ্রু হয়ে উঠেছে অশ্রুপ্রতিমা। তাই বিদ্যাপতি কারুণ্যের শ্রেষ্ঠ রূপকবি।


👉👉   উপরের আলোচনা তে আমরা বৈষ্ণব পদাবলীর মাথুর পর্যায় এবং মাথুর পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি নিয়ে আলোচনা করেছি। প্রয়োজন হলে আপনি অবশ্যই বিভিন্ন বৈষ্ণব পদাবলীর প্রশ্ন গুলি যা আলোচনা করা হয়েছে তা দেখে নিতে পারেন। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অনান্য প্রশ্নগুলি নিচে দেওয়া হল সেখান থেকে আপনি দেখে নিতে পারেন।