বৈষ্ণব পদাবলীতে ভাবোল্লাস ও ভাবসম্মিলন কি ? ভাবোল্লাস ও ভাবসম্মিলন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করো- pdf

     বৈষ্ণব পদাবলীতে যথারীতি পূর্বরাগ, অভিসার আক্ষেপানুরাগ এর পরবর্তীতে রাধার ভাবসম্মিলন পর্যায়টি চিত্রিত হয়েছে। এই পর্বটি বৈষ্ণব পদাবলীতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। রাধা এবং কৃষ্ণের মিলনে যেভাবে রুলার সৃষ্টি হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলীর কবিরা তাকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। তাই আমরা এখানে ভাবসম্মিলন ভাবোল্লাস কি এবং ভাবসম্মিলন ও ভাবোল্লাস পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করব।



ভাবোল্লাস ও ভাবসম্মিলন কি ? 


   বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে শৃঙ্গার বা মধুররসের দুটি প্রধান বিভাগ –


  1. বিপ্রলম্ভ
  2. সম্ভোগ

বৈষ্ণব সাহিত্যের বিপ্রলম্বের চার পর্যায়ের পর সম্ভোগের স্থান। সম্ভোগের সংজ্ঞা সম্বন্ধে বলা হয় –


“দর্শনালিঙ্গনাদীনামানুকূল্যানিম্নষেবয়া
যুনোরুল্লাসমারোহন্‌ ভাবঃ সম্ভোগ ইর্ষ্যতে।।”

অর্থাৎ দর্শন আলিঙ্গনাদির দ্বারা নায়ক-নায়িকার যে ভাবোল্লাস তাকেই সম্ভোগ বলে। সম্ভোগের প্রধান দুটি ভাগ – মুখ্য ও গৌণ

ভাবোল্লাস ও ভাবসম্মিলন কি


জাগ্রত অবস্থায় মুখ্য সম্ভোগ চারভাগে বিভক্ত –


  1. সংক্ষিপ্ত
  2. সংকীর্ণ
  3. সম্পন্ন
  4. সমৃদ্ধিময়।

পূর্বরাগের পর মিলন হয় সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ। ভয়, লজ্জা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি কারণে নায়ক-নায়িকার মিলন সংক্ষিপ্ত হয় বলে একে বলা হয় সংক্ষিপ্ত সম্ভোগ।


মানের পর মিলনে নায়কের উপর পরিপূর্ণ আস্থা স্থাপনে সমর্থ না হয়ে নায়িকা যখন পরিপূর্ণভাবে ধরা না দেয় তখন হয় সংকীর্ণ সম্ভোগ। অদূর প্রবাসের পর মিলনে হয় সম্পন্ন সম্ভোগ। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে এর ‘অগতি’ এবং ‘প্রাদুর্ভাব’ দুই শাখা।


সুদীর্ঘকাল নায়ক-নায়িকার যদি বিচ্ছেদ বর্তমান থাকে এবং তারপর যদি মিলন হয় তখন তাকে সমৃদ্ধিময় সম্ভোগ বলে।


সম্ভোগের অপর বিভাগের নাম গৌণ সম্ভোগ। এটি স্বপ্ন সম্ভোগ নামেও পরিচিত। গৌণ সম্ভোগ নামের তাৎপর্য এই যে এখানে রাধা-কৃষ্ণের প্রত্যক্ষ দর্শনজাত মিলন ঘটেনি। বিরহের তীব্রতায় ভাবের ঘোরে কিংবা স্বপ্নাবস্থায় কৃষ্ণের সঙ্গে রাধার যে মিলন সেটাই গৌণ সম্ভোগ। এই ভাবজগতে রাধা-কৃষ্ণের মিলনকে ভাবোল্লাস বা ভাবসম্মিলন বলে। ভাবোল্লাসে রাধা-কৃষ্ণের মিলন লীলা সম্পূর্ণ হয় বৃন্দাবনে রূপজগতে নয়, রাধার অন্তর্জগতের বৃন্দাবনে।



ভাবসম্মিলন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি


ভাবসম্মিলন ও ভাবোল্লাস পর্যায়ের পদ রচনা করেছেন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখ কবিগণ। কিন্তু ভাবসম্মিলন ভাবোল্লাসের পদে বিদ্যাপতি প্রতিদ্বন্দ্বীহীন। বিদ্যাপতি পরম সুখে মিলনের রসাবেশ বর্ণণা করেছেন। কিন্তু মিলনের বর্ণনাতেই তিনি নিজের শ্রেষ্ঠ পূজা-উপচার সমর্পণ করেননি। মিলনের পর বিরহ এসেছে, তারপর ভাবসম্মিলন। বিদ্যাপতি ভাবসম্মিলনের কবি


  রাধার নয়নপদ্মের পাপড়ি প্লাবিত করে যে অশ্রু নিশিদিন ঝরেছে, কোন এক মধুমিলনের কল্পনায় সেই অশ্রুকে নয়নপদ্মে বেঁধে তার উপর আনন্দের আলোকসম্পাত করেছেন কবি। কবি এই অশ্রুজলা সকরুণ আলোকটুকুকে ভাবসম্মিলনের পদে তুলে ধরেছেন। স্বপ্নে সান্ত্বনালাভের এই প্রয়াসে কতবড় দুঃখের অভিব্যক্তি লুকিয়ে আছে তা কবি এই পর্যায়ের পদে বলে গেছেন। বিদ্যাপতি এখানে দেহসৌন্দর্য বর্ণনায় বিচিত্র বর্ণ বিন্যাসের চমক সৃষ্ট করেননি।


   বিরহের ভাবোল্লাসে তিনি ভাব গভীরতার নিবিড় উপলব্ধিতে রাধাকে আনন্দময় প্রশান্তির দিব্যকান্তি দান করেছেন। বিদ্যাপতিকে সুখের কবি বলা হয়। কিন্তু পরম সত্য যে অনাদির দুঃখ তাঁর কাব্যের ভূষণ। তাই বলা যায় তিনি সুখের কবি, দুঃখেরও কবি এবং একই সঙ্গে সুখ-দুঃখাতীত আনন্দের কবি। The human body is the highest temple of God – বিদ্যাপতি যেন এই পরম সত্যের সন্ধান পেয়েছেন। পরম প্রিয়কে পেয়ে তাই শ্রীমতী রাধা বললেন –


“আজু রজনী হাম 	ভাগে পোহায়লুঁ
পেখলুঁ পিয়ামুখচন্দা।
জীবনযৌবন 	সফল করি মানলুঁ
দশদিশ ভেল নিরনন্দা।।”

নবপ্রেমের রসলাস্যের চতুর কবিশিল্পী বিদ্যাপতির এই পদে বর্ণিত প্রেমের অতি গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী অনুভূতির প্রকাশ। এখানে প্রকাশ পেয়েছে প্রাণভেদী উল্লাসরব, সুখ-দুঃখের অতীত আনন্দবাণী। রাধা একবারমাত্র কৃষ্ণকে দর্শন করেছেন। ফলে তার দুঃখ-নিশি আবার আনন্দের প্রভাতী অভ্যর্থনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে বলেছে –


“আজু বিহি মোহে 	অনুকূল হোয়াল
টুটল সবহুঁ সন্দেহা।”

রাধার ব্যর্থ দেহ, শূন্যঘর আজ কৃষ্ণের সান্নিধ্যে তাৎপর্য খুঁজে পেয়েছে। তাই রাধা দুঃখদায়ক বস্তুগুলিকে সুখের দিনে সুখ ইন্ধনরূপে আহ্বান করেছে –



“সোই কোকিল অব 	লাখ লাখ ডাকউ
লাখ উদয় করু চন্দা।
পাঁচবাণ অব 	লাখ বাণ হোউ
মল পবন বহু মন্দা।।”

তাই আজ সহস্র চন্দ্র উদয় হলেও ক্ষতি নেই, শীতল সুগন্ধময় মলয় দিনরাত প্রবাহিত হলেও ক্ষতি নেই। লাখ কোকিলের ডাক, লক্ষ পঞ্চশর আজ তার কাছে প্রতিকূল নয়, কাঙ্খিত। বাস্তবে রাধা-কৃষ্ণের মিলন হয়নি তখনও। তবুও ভাববৃন্দাবনের মানসকুঞ্জে রাধা তার প্রাণপ্রিয় কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের আনন্দে রত। বিরহের দুঃখ সাগর মন্থন করে ভাবলোকের এই প্রেম, সম্ভোগের উল্লাস সত্যই বিস্ময়ের। এ প্রেম বিচ্ছেদের মাঝে নতুন রূপে তরঙ্গিত হয়ে ওঠে। সেই তরঙ্গের উল্লাসে ক্ষণকালের প্রেম চিরকালের প্রেমে উত্তীর্ণ হয়ে যায়।


   আবার চিরপ্রবাহের অবিচ্ছিন্নতার মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে আস্বাদনের আঘাতে তরঙ্গ ওঠে। তখন ‘চির’ প্রেম চির থেকে ‘নব’ হয়ে ওঠে। রাধার এই নব প্রেমের আনন্দময় রূপ বর্ণনায় ভাষা-ছন্দ-সুর সবকিছুই এই কবিতা ভাবের সঙ্গে মিলিত হয়ে অপরূপ কাব্য দেহের সৃষ্টি করেছে।


প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন 

  ভাবসম্মিলনের এই পদে রাধা কেবল কৃষ্ণকেই লাভ করেনি বিরহের যন্ত্রণাকে জয় করার সাধনাতেও যেন সিদ্ধিলাভ করেছে। রাধার শাশ্বত প্রেম কল্পলোকের পথেও তৃপ্তির ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। ভাবোল্লাসে বিদ্যাপতির রাধা তাই শুধু প্রেম পূজারিণী নয়, স্বয়ং প্রেম রূপিণী।


👉👉   বৈষ্ণব পদাবলীতে উপরের ভাবোল্লাস ও ভাবসম্মিলন পর্যায়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভাবে আলোচনা করা হয়েছে অবশ্যই এখান থেকে আপনারা নোট হিসেবে এটিকে লিখে নিতে পারেন। এছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলী এবং অনান্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রশ্ন গুলি নিচে থেকে দেখে নিতে পারেন।