বৈষ্ণব পদাবলী - বিদ্যাপতির অন্তর্ভুক্তির কারণ - বিদ্যাপতির কবি প্রতিভা আলোচনা - বিদ্যাপতির ভাষা ব্রজবুলি - pdf

    বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণ রাধার প্রণয়লীলা কে অবলম্বন করে বৈষ্ণব পদাবলীর অবতরণ হয়। প্রাকচৈতন্য যুগের শ্রেষ্ঠ দুজন বৈষ্ণব পদাবলীর রচয়িতা ছিলেন বিদ্যাপতি চন্ডীদাস। এই দুই শিল্পীর পদ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু নিজে শুনতে চাইতেন।

বৈষ্ণব পদাবলী - বিদ্যাপতি
Educostudy.in/বিদ্যাপতি



 এই কারণে বাঙালিরা মনেপ্রাণে এই দুই শিল্পী কে আপন করে নিয়েছে। তবুও আলোচনার বিষয় বিদ্যাপতি নিজে বাঙালি ছিলেন না কিন্তু বাঙালিরা থাকে আপন করে নিয়েছিল। এখানে বিদ্যাপতির বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্তির কারণ তাঁর কাব্য প্রতিভা এবং তার সৃষ্টি ব্রজবুলি ভাষা নিয়ে আলোচনা করা হলো। 



বিদ্যাপতি বাঙালি নন কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাকে কেনো গ্রহণ করা হয়েছে তা আলোচনা করো। 


   বিদ্যাপতির জন্মস্থান বাংলা নয়, মিথিলা। কাব্যভাষা বাংলা নয়, ব্রজবুলি। আবার কবি বাংলায় আদৌ এসেছিলেন কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ থেকেই যায়। অনেক মৈথিলি ও হিন্দি সাহিত্যের ঐতিহাসিক বিদ্যাপতির অবহট্টঠ ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত কাব্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে বিদ্যাপতিকে মিথিলার সম্পদ করে রাখতে চান।


 এইসব সংশয় জটিলতায় বিদ্যাপতির বাঙালীত্ব দাঁড়িয়ে যায় প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীনে। তবে একথা ঠিক বিদ্যাপতির কবি খ্যাতিকে বাঙালীই পবিত্র হোমাগ্নির মত রক্ষা করেছে। বৈষ্ণব মহাজনরা বহুদিন পূর্বেই তাঁকে আপন করে নিয়েছেন। মহাপ্রভু চৈতন্যের জীবনেও বিদ্যাপতির সুস্পষ্ট প্রভাব ছিল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখছেন –


“চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি 	রায়ের নাটকগীতি
কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ।
স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রদিনে
গান শুনে পরম আনন্দে।।”

এই সব কিছুর দিকে লক্ষ রেখে অধ্যাপক শ্যামাপদ চক্রবর্তী বলেছেন –


“তদানীন্তন মিথিলা দীর্ঘকাল ধরিয়া বাঙালীর স্বারস্বত তীর্থক্ষেত্র ছিল। --- সেই ধারা পানে যে কয়েকটি চাতক আনন্দে গাহিয়া উঠিয়াছিল বিদ্যাপতি তাহাদের মধ্যে প্রাচীনতম। সাধারণ মিথিলাবাসী যেখানে মুগ্ধ হইবে না এবং বাঙালীই তাহা কান পাতিয়া শুনিবে একথা তাহাদের অজ্ঞাত ছিল না।”


বস্তুত মিথিলা কবির জন্মভূমি। কিন্তু তাঁর কাব্যকৃতির লীলাভূমি বাংলা আর বাঙালীর হৃদয়রাজ্য। বাঙালী দীর্ঘকাল জানত না যে বিদ্যাপতি মিথিলার কবি, মিথিলাও তাঁকে ভুলে গিয়েছিল। হতে পারে বাংলায় বিদ্যাপতির পদাবলী প্রচারিত না হলে বিদ্যাপতি হয়ত হারিয়েই যেতেন। বাঙালীর দীর্ঘদিনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, বিরহ-মিলন এই সবকিছুর সঙ্গে বিদ্যাপতি সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন। বাঙালীর রসসিক্ত হৃদয়ে ভালোবাসার রাখীবন্ধন নিয়ে বিদ্যাপতির দীপ্ত অধিষ্ঠান। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন তাই বলেছেন –


“বাঙালী বিদ্যাপতির কুর্তা-পাগড়ী খুলিয়া লইয়া ধুতি-চাদর পরাইয়া দিয়াছে।”



বিদ্যাপতির কবি প্রতিভা আলোচনা করো ।


বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী বাংলা সাহিত্যের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গনে তাঁর অমর প্রতিষ্ঠার কারণ। সেইজন্য কোন কোন সমালোচক তাঁকে বলেছেন ‘কবি সার্বভৌম’। বয়ঃসন্ধি বা পূর্বরাগের পদে রাধা লীলাচপল; যৌবনসুচতুরা কলাবতী। এখানে সে বিদ্যাপতির মানস সুন্দরী। এখানে কেবল ভাস্করের মতো বহিরঙ্গের পাথর কেটে প্রতিমা তৈরি নয়, এখানে রয়েছে এক আত্মসচেতন নারী জীবনের মনদ্বন্দ্ব এবং প্রবল উল্লাসে থরথর কম্পিত আরক্ত পুলক –


শৈশব যৌবন দুঁহু মিলি গেল।
শ্রবণক পথ দুঁহু লোচনক নেল।।
বচনক চাতুরী লহুলহু হাস।
ধরা নীয়ে চাঁদ করএ পরকাশ।।


জীবনের এই মধু বসন্তে রাধা নিজের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। তার প্রেমলোকে সমস্ত বিশ্ব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। কবি তার প্রগাঢ় মনধর্মীতা ও গভীর রসধর্মিতা নিয়ে প্রেম সৌন্দর্যের অপরূপ স্থাপত্য নির্মাণ করেছেন –


জঁহা জঁহা পদযুগ ধরঈ।
তঁহা তঁহা সরোরুহ হরঈ।।
জঁহা জঁহা ঝলকত অঙ্গ।
তঁহি তঁহি বিজুরি তরঙ্গ।।


রাধার সেই অপার্থিব সৌন্দর্যে কৃষ্ণ বিমুগ্ধ হয়ে যায়। আবার রাধাও একদিন যমুনাতেই খনিকের জন্য দেখা পেয়েছেন কৃষ্ণের। যেন বহুযুগ সঞ্চিত এক অজ্ঞাত পুলকে ভরে ওঠে তনুমন প্রাণ। মনে মনে বলতে থাকেন রাধা –


তরুতলে ভেটল তরুর কানাই।
নয়ন তরঙ্গে জানি গেলিছে সানাই।।


যমুনাতীরে কৃষ্ণের বাঁশি বাজে। রাধা সে বাঁশিকে উপেক্ষা করতে পারে না। তাই দুর্যোগের অন্ধকার রাতে ছুটে চলে কৃষ্ণকে দেখার জন্য –


নব অনুরাগিনী রাধা।
কিছু নাহি মানে রাধা।।
একলি বা এল পরাণ।
পথ বিপথ মান।।


জীবনের পরম শ্রেয়কে পাওয়ার বাসনায় রাধা কত সহজে সমাজকে উপেক্ষা করেছে। অভিসারের এই তীব্র বাসনায় ভালোবাসা পূজা হয়ে উঠেছে।


বিদ্যাপতির কবিতায় মিলনের আনন্দ পরিতৃপ্তির মুহুর্তকে এক অদ্ভূত অপরিতৃপ্তি রহস্ময় বেদনায় শাশ্বত মহিমা দান করেছে। মিলনের তৃপ্ত মুহুর্তে অতৃপ্ত রাধার উক্তি তাই স্মরণীয় হয়ে থাকে –


জন্ম অবধি হাম 		রূপ নেহারলুঁ
নয়ন না তিরপিত ভেল।।
সোই মধুর বোল 		শ্রবণহি শুনলুঁ
শ্রুতি পথে পরশ না গেল।।

রাধা কৃষ্ণের জন্য সমুদ্রতীরে অপেক্ষা করে চলে, কিন্তু দিন যায় রাত কেটে যায়, অপেক্ষার প্রহরগুলি বেদনার মহাকাল হয়ে ওঠে। সে বেদনা দিগন্ত ছোঁয়া আর্তিতে ভাষারূপ পেয়েছে মাথুর পর্যায়ের পদে –


অঙ্কুর তপন 		তাপে যদি জারব
কি করব বারিদ মেহে।
এ নব যৌবন 		বিরহে গোঁঞায়ব
কি করব সো প্রিয়া লেহে।।

এই বিচ্ছেদ সহ্য করতে না পেরে ভাবসম্মিলনের পথে রাধা নিজের দেহ মন্দিরে কৃষ্ণের স্বপ্নমূর্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। নয়নের সম্মুখে তিনি তো নেই, তবু নয়নের মাঝখানে যে আছে। এই আনন্দের অভিব্যক্তি অ-পার্থিব মিলনের ভাবোল্লাসে সার্থক করেছে জীবন- যৌবন। সেখানে দ্বন্দ্ব সংশয় অপেক্ষা নেই। অপূর্ব আত্মতৃপ্তিতে রাধা বলেন –


আজু রজনী হাম 	ভাগে পোহায়লুঁ
পেখল প্রিয়া মুখ চন্দা।
জীবন যৌবন 		সফল কবি মানলুঁ
দশদিশ ভেল নিরনন্দা।।

বিরহের মধ্যেই উত্তপ্ত চোখের জল মুছে গেছে কখন। শুধু দীপ্যমান থেকেছে প্রেমের নিত্যকালের মহিমা।


পার্থিব জীবনের রসঘন জয়গান অপার্থিব পারিজাতের সন্ধান এনেছে প্রার্থনা বিষয়ক পদে। সাধনার প্রেমারতির স্তর অতিক্রম করে কবি এই পর্যায়ে আত্মসমীক্ষার ভাববিষ্ট ভক্তির পাদপিঠে নতজানু হয়ে বসে তার জীবন দেবতার কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করেছেন –


মাধব বহুতো মিনতি করি তোয়
দেই তুলসী তিল  	এ দেহ সমর্পিলু
দয়া জনু ছোড়বি মোয়।

বস্তুত কবিপ্রতিভা যে ভূমিতে অবস্থান করেছে সেখানে সকল জিজ্ঞাসা স্তম্ভিত। সে প্রজ্ঞা জ্ঞানকেও অতিক্রম করে। কবির অঘটন-ঘটন-পটীয়সী প্রতিভায় প্রেম হয়ে উঠেছে রক্তের ধর্ম –ব্যক্তিসম্পর্কের নিবিড় চেতনা। সর্বোপরি কবির আবেদন স্থান-কাল-পাত্রের সীমা উত্তীর্ণ হয়ে এক Universal রস প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়েছে।



  তাই বলা যায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের আকাশ যদি কখনো সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে যায়, বিস্মৃতি যদি কখনো বাংলা সাহিত্যের রত্নভাণ্ডারকে গ্রাসও করে নেয়, জীবনের রুক্ষ বাস্তবতায় কাব্যের স্পন্দিত আবেগ যদি কখনো কবরস্থ হয়ে পড়ে তবুও বিদ্যাপতির ছোট ছোট কবিতাগুলি নিত্যকালের না হারানোর দাবি নিয়ে রসমধুর অম্লান মহিমায় বেঁচে থাকবে চিরকাল।


বিদ্যাপতির পদাবলীর ভাষা ও ব্রজবুলী

মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ঠিক কোন ভাষায় তার পদাবলী রচনা করেছিলেন তা এক দুরূহ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বিদ্যাপতির ভাষা বাংলা নয় একথা ঠিক। পণ্ডিতরা বিদ্যাপতির রচিত ভাষাকে ব্রজবুলী নাম দিয়েছেন। ব্রজবুলী কিন্তু বিদ্যাপতির সৃষ্ট ভাষা নয়।


 ষোড়শ শতাব্দীতে আসামে ‘ব্রজবোলি’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া গেছে। যতদূর সম্ভব একালে ঈশ্বর গুপ্ত প্রথম ‘ব্রজবুলী’ ভাষা ব্যবহার করেছিলেন। তবে একথা বাংলা দেশে কাব্যরসিক জনসাধারণের মুখে এ ভাষাটি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত হয়ে এসেছে। একসময় বাঙালি বিশ্বাস করত ব্রজবুলী ব্রজ অর্থাৎ বৃন্দাবনের ভাষা এবং এও ধারণা ছিল যে বৃন্দাবনের রাধা-কৃষ্ণ ও তাদের সখিরা এই ভাষাতেই কথা বলতেন। কিন্তু এটা ভুল।


প্রশ্নের উত্তর টির Pdf File ডাউনলোড বিনামূল্যে


 বৃন্দাবনের স্থানীয় মানুষ যে ভাষায় কথা বলে তা একটি জীবন্ত ও লৌকিক ভাষা। তার নাম ব্রজভাখা। এটি শৌরসেনী অপভ্রংশের বংশজাত। অপরদিকে পদাবলীর ব্রজবুলী ভাষা মাগধী অপভ্রংশ থেকে জন্ম নিয়েছে। এটি কৃত্রিম ভাষা। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে বা ঐ জাতীয় সাহিত্য ছাড়া এর অন্য ব্যবহার নেই এই ভাষায় কেউ কথা বলেনি। ব্রজবুলী ভাষার ভিত্তি মৈথিলি ভাষা। মিথিলা একসময় নব্য-ন্যায়ের পীঠস্থান ছিল।