বৈষ্ণব পদাবলী - কবি জ্ঞানদাসের কবি পরিচয়, কাব্য প্রতিভা নিয়ে আলোচনা - pdf

 বৈষ্ণব পদাবলী ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জ্ঞানদাস। বৈষ্ণব পদাবলীতে যাকে নিয়ে বহু সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে তিনি বিশিষ্ট পদাবলী কার জ্ঞানদাস। কবি জ্ঞানদাসের বিশিষ্ট পরিচয় কাব্য প্রতিভা নিয়ে এখানে আলোচনা করা হলো। যে সমস্ত আলোচনা গুলি বাংলা বিষয়ের বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

কবি জ্ঞানদাসের কবি পরিচয়, কাব্য প্রতিভা নিয়ে আলোচনা
Educostudy.In/জ্ঞানদাস 



পদাবলী কার জ্ঞানদাস

বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের ধারায় জ্ঞানদাস রোমাণ্টিক Lyric প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। নিজের অন্তর গাঢ় অনুভূতিকে সংহত কাব্যরূপে প্রকাশ করার ক্ষমতা কবির ছিল। রূপ বিলাসের সঙ্গে অনুভূতির এই গভীরতা মিশিয়ে জ্ঞানদাস কাব্যসৃষ্টি করেছিলেন। চণ্ডীদাসের মতই তাঁর কাব্যে অনাড়ম্বর সরলতা রয়েছে, যদিও কবি তার পূর্বজের মত Mystic হয়ে ওঠেননি। তার কবিদৃষ্টি মর্মলোকে রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবন আবিষ্কার করেছে। প্রাণতন্ময় কবি তিনি, তাই তাঁর রাধার কথা আসলে তাঁর নিজের কথা। সেই একান্ত ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার বাণী রস সৃষ্টির কৌশলেই নিত্যকালের হয়ে উঠেছে।


জ্ঞানদাসের কবি পরিচয়

মধ্যযুগের অন্যান্য কবিদের মতো জ্ঞানদাসের ক্ষেত্রেও জীবন সম্পর্কে তথ্য বড় দুর্লভ। ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ নিত্যানন্দ শাখায় জ্ঞানদাসের নামোল্লেখ আছে। বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে কাঁদড়া গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে কবির জন্ম আনুমাণিক ১৫৩০ খ্রীষ্টাব্দে। নিত্যানন্দের পত্নী জাহ্নবীদেবীর কাছে তিনি বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা নেন। কবি নিত্যানন্দ লীলার প্রতক্ষ্যদর্শী।


  নিত্যানন্দের মৃত্যুর পর জাহ্নবীদেবীর সঙ্গে তিনি বৃন্দাবনে তীর্থ করতে যান। বৃন্দাবনে কবি শ্রীজীব, রঘুনাথদাস, গোপালভট্ট, কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রভৃতি বিখ্যাত বৈষ্ণবাচার্যদের ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন। নরোত্তমদাস আয়োজিত খেতুড়ির মহোৎসবে যোগ দিয়েই গোবিন্দদাস ও বলরামদাসের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। চিরকুমার কবির সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানা যায় না। তার ভনিতায় প্রায় ৪০০ পদ পাওয়া গেছে। যদিও তার মধ্যে সবই তার রচনা নয়।


কবি জ্ঞানদাসের কবিকৃতিত্ব

জ্ঞানদাস বৈষ্ণবপদাবলীর প্রায় সমস্ত পর্যায়েরই পদ রচনা করেছেন। গৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দবিষয়ক বেশ কিছু পদ তার নামে পাওয়া যায়। বিশেষত নিত্যানন্দ বিষয়ক পদাবলীতে প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা আছে –


পাট বসন পরে নিতাই মুকুতা শ্রবণ।
ঝলমল ঝলমল নানা আভরণে।।
সঙ্গে সঙ্গে যায় নিতাইর রামাই সুন্দর।
গৌড়দাস আদি কবি যত সহচর।।


রাধাভাবে আকুলিত চিত্ত গৌরাঙ্গের দিব্যমূর্তির প্রকাশও তার কাব্যে চমৎকার –


সহচর অঙ্গে গোরা অঙ্গ হেলাইয়া।
চলিতে না পারে খেনে পড়ে মুরছিয়া।।
অতি দূর বলদেহ ধরণে না যায়।
ক্ষিতি তলে পড়ি সহচরমুখ চায়।।


তবে গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদে ভাগ গভীরতায় ও মণ্ডনকলায় কবি গোবিন্দদাসকে অতিক্রম করতে পারেননি।


বাল্যলীলা নিয়েও জ্ঞানদাসের কিছু পদ আছে। সেখানে যেমন বালক কৃষ্ণের পরিচয় আছে তেমনই কোন কোন পদে বালিকা রাধার পরিচয় আছে। বাল্যলীলার পদে বাৎসল্য ও সখ্যরসের সঙ্গে কখনও তিনি মধুর রসের মিশ্রণও ঘটিয়েছেন। গোষ্ঠযাত্রার একটি পদ এইরকম –


সাজ সাজ বলিয়া পড়িয়া গেল সাড়া।
বলরামের শৃঙ্গাতে সাজিল গোয়ালপাড়া।।
হাম্বা হাম্বা রব সে উঠিল ঘরে ঘরে।
সাজিল কাচিয়া সবে হইলা বাহিরে।।


তবে জ্ঞানদাসের প্রতিভার স্ফূর্তি তার তাঁর পূর্বরাগ, অনুরাগ, রূপানুরাগ ও রসোদ্গারের পদে। তবে ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর’ – শীর্ষক পদটিতে কৃষ্ণের রূপাগুণের প্রতি আকর্ষণ ব্যক্ত হয়েছে। ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর’ – এই পংক্তিতে দেহমিলনের যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাই আবার দেহাতীত প্রেমে উত্তীর্ণ, যখন কবি বলেন –


ঘরে যাইতে পথ মোর হইল অফুরান।
অন্তরে বিদরে হিয়া কি জানি করে প্রাণ।।


অভিসার পর্যায়ের পদে জ্ঞানদাসের ১৬টি পদ পাওয়া যায়। বাসকসজ্জিকা রাধা জ্ঞানদাসের কবিতায় অপেক্ষার আর্তি নিয়ে বসে আছেন। মেঘমন্দ্রিত বর্ষণ মুখর রাতে কুঞ্জে এসে অপেক্ষা করতে করতে রাধা ভাবেন –


এ ঘোর রজনী 		মেঘ গরজনী
কেমনে আয়ব প্রিয়া।

তবে এখানেও বিদ্যাপতির পদাঙ্কই তিনি অনুসরণ করেছেন। এই পর্যায়ে কৃষ্ণ চরিত্রটি পাঠকের নজর কাড়ে। খণ্ডিতা রাধার মান ভাঙনের জন্য কৃষ্ণ রাধার পায়ের ধূলি স্পর্শ করতে চান, তার সাধের বাঁশিটি দিয়ে দিতে চান। রাধার দুচোখের দৃষ্টিতে কৃষ্ণ বিশ্বশ্রেষ্ঠা প্রেমের প্রতিমাকে খুঁজে পায়। এ নিঃসন্দেহে চৈতন্যেত্তর কবির বৈশিষ্ট্য।


দানলীলা ও নৌকাবিলাসের পদেও জ্ঞানদাস দক্ষ। এই পর্যায়ে রাধা অনেক প্রখরা। এখানে রাধাকৃষ্ণের কলহ কৃত্রিম কলহ। আক্ষেপানুরাগের পদেও জ্ঞানদাসের রাধার দ্বিধাবিচলিত চরিত্রটি ফুটে ওঠে। একদিকে কৃষ্ণপ্রেম, অন্যদিকে সমাজ সংসার এই দ্বন্দ্বব্যাকুল বেদনা ভারাক্রান্ত রাধা। এই যন্ত্রণা জ্ঞানদাসের কবিতায় অতলস্পর্শী শূন্যতায় প্রেমের আলোক সামান্য প্রদীপখানি জ্বালিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।


সুখের লাগিয়া 		এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয় সাগরে 		সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।।

নিবেদন ও ভাবোল্লাসের পদে জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের কৃতিত্বকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। ভাবোল্লাসেও জ্ঞানদাসের রাধার কৃষ্ণপ্রেম বিরহের অন্ধকারে ভাবী মিলনের আনন্দে উদ্বেগ।


রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানদাসের কবিধর্মের রোমাণ্টিক বৈশিষ্ট্যটি আবিষ্কার করে লিখেছিলেন –


"কবিতা যে ভাষা ব্যবহার করে সেই ভাষার প্রত্যেক শব্দটির অভিধান নির্দিষ্ট অর্থ আছে। সেই বিশেষ অর্থে শব্দের তথ্যসীমা। এই সীমাকে ছাড়িয়ে শব্দের ভিতর দিয়েই তো সত্যের অসীমতাকে প্রকাশ করতে হবে।"


তাই জ্ঞানদাস যখন বলেন –


রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।


তখন মনে হয় এই কবি ভাষা মধ্যযুগের নয়, নিতান্ত একালের। এ হারানোর মধ্যে, এই পথ ফুরানোর মধ্যে যে কথা বলা আছে তা কেউ প্রকাশ করতে পারেনি। সেই অপ্রকাশের অতৃপ্তি আর আনন্দে সেই অজানার রসরহস্য বিলাপে যুগে যুগে কবিচিত্ত উল্লসিত। জ্ঞানদাসের রাধা যখন বলেন –


শিশুকাল হৈতে 		বন্ধুর সহিতে
পরাণে পরাণে নেহা।

তখন রবীন্দ্রনাথের কবিতাই মনে আসে আমাদের –


আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয় উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহ বিধুর নয়ন সলিলে
মিলন মধুর লাজে।


রোমাণ্টিকতার সঙ্গে যে রহস্যময় অনুভূতি যে স্বপ্নময়তা আর যে অনির্দ্দেশ্য বেদনাবোধ একাকার হয়ে থাকে। জ্ঞানদাসের কবিতায় সেই রোমাণ্টিক প্রেমের পরিচয়ে ধরা আছে। অশ্রুউদ্বেল দুটি চোখের প্রেমার্তিময় প্রশ্ন জ্ঞানদাসের কবিতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে –


"তোমায় আমায় একই পরাণ
ভালো সে জানিয়ে আমি।
হিয়ার হইতে বাহির হইয়া
কিরূপে আছিলা তুমি।।"