হাঁসুলিবাঁকের উপকথা উপন্যাসের পাখি চরিত্র | তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় | পাখি চরিত্র

    কাহার, বাউরি, সাওতাল, ডোম প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কথা যে সাহিত্যিক প্রথম লেখনী রূপে তুলে ধরেছিল তিনি তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় । তাকে ইংরেজি সাহিত্যের টমাস হার্ডির সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। তার হাসুলি বাঁকের উপকথা উপন্যাস টি অন্যতম এবং বেশ উল্লেখযোগ্য। এই উপন্যাসের পাখি চরিত্র সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো

হাঁসুলিবাঁকের উপকথা উপন্যাসের পাখি চরিত্র


হাঁসুলিবাঁক উপন্যাসের পাখি চরিত্র


    সুচাঁদের নাতনি বসনর মেয়ে পাখি। উপকথার একমাত্র নারী চরিত্র যে উপকথায় আধিদৈবিক জগতের বাইরে ব্যতিক্রমী চরিত্র। সু্চাঁদ আদ্দিকালের বদ্যি বুড়ি। সে প্রাচীনকালের লোকপুরাণের জগতের বাসিন্দা। বসন সুঁচাদের মত অতখানি প্রাচীনতাকে আকড়ে ধরে থাকে না। কালগত ব্যবধান তার মনে অঙ্কিত হয়েছে। পাখি বসনের চেয়েও আধুনিক। নতুন যুগের নবদূত করালীর যোগ্য সহধর্মিনী পাখি।

    পাখির দেহে চৌধুরী কর্তার ছেলের রক্ত। বসনের ‘অঙের খেলার’ ফসল পাখি। চৌধুরীদের রক্তের তেজ,মননের অধিকার তাই স্বাভাবিক। করালী তার ‘অঙের মানুষ’। করালীর প্রতি কোনো বিরূপ মন্তব্য ও সহ্য করতে পারে না।

    পাখি হেঁপো রোগী নারানের বিয়ে করা বউ। সুচাঁদ মাতব্বর বংশের নারানের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছিল। তখন অবশ্য নারান হেঁপো রোগী ছিল না। পাখি নারাণের সংসারে তার সঙ্গে থাকতে চাই না। সুচাঁদ পাখির এই মনোভাবের বিরুদ্ধে। নারান ও তার মা পাখিকে ছাড়তে চায় না। পাখি তাসত্ত্বেও করালীর গুনগ্ৰাহী সমর্থক ও প্রেমিকা। সে বসনর মেয়ে তাই সাপ মেরে করালি যখন সগর্বে বলেছিল —

     ‘মুরুব্বী কত্তার পুজোটা সব আমাকে দিও গো’।   পাখি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে করালীর পিঠে       একটা আদরের কিল মেরে বলেছে -                 ডাকাবুকো লঘু গুরু জ্ঞান নাই তোমার ?

    পাখি এযুগের কাহার কন্যে। তাই সাপকে সাপ বলেই জানে। কত্তাবাবা সম্পর্কে আদিম বিশ্বাস তাকে বেধে রাখেনি। তাই সুচাঁদ যখন সাপ‘ হে বাবা, হে বাবা ’বলে কান্না জুড়ে পাখি তখন প্রতিবাদ করে বলে — মরণ ! ঢং দেখো ! দোপরবেলায় কাঁদতে বসল দেখো। সাপ আবার বাবা হয়। পাখি দৃঢ় ও তেজী চরিত্রের মেয়ে তাই সুচাঁদ যখন চৌধুরী রক্তের খোটা দেয় তখন —

     “পাখির চিৎকারে ঠিক মাথার ওপরে                   আকাশে উড়ন্ত চিলটাও বোধকরি চমকে             উঠল, অন্তত তাই মনে হল। ঠিক মাথার             উপরে যে চিলটা স্থির পাখা মেলে ভেসে               চলেছিল বলে মনে হচ্ছিল, সেটা এই                 মুহূর্তেই সজোরে পাখা আন্দোলিত করে               দ্রুত বেগে অতিক্রম করে গেল স্থানটা ”               বললে আমি জানিনা তোমার বেবরণ —, লয় ?

      ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথার' তুফান বানে ঝাঁপ খেয়ে যুবতী বউ পালাই যার উপরে মন পড়ে তার কাছে,তার গাছেব ওপরে তার পাতা সংসারেই গিয়ে উঠে বসে ?.............. পাখিও চলে করালীর বাড়ি। সমাজ আর শাসনের মুখে ঝাঁটা মেরে পাখির এই চলে যাওয়া একান্তই ভালোবাসার টানে ‘ অঙের মানুষের কাছে ’ করালীর গর্বে পাখি গর্বিতা। চন্দ্রবোড়া সাপ কে পুড়িয়ে মারার পুরস্কার স্বরূপ দারোগার আগমনে তার অভিব্যক্তি — 

     “পাখি শুতে যাবার জন্য উঠেছিল,- সে                দরজার মুখে ঢুকেছিল,ছোট দারগা                    করালীর নাম করতেই থমকে দাঁড়াল —              তারপর হঠাৎ দাওয়া থেকে লাফিয়ে নেমে            মজলিসকে পাশ কাটিয়ে অন্ধকারের মধ্যে          দিয়ে সাদা কাপড়ের দোলায় খানিকটা                ঝলক তুলে ছুটে বেরিয়ে গেল। ”

    পাখি করালীর সঙ্গে চন্দনপুরে গিয়ে উঠেছে। নয়াণের নাছোড়বান্দা মনোভাবের প্রেক্ষিতে সে বলেছে — ‘ যার সঙ্গে মেলে মন,সেই আমার আপনজন — ইয়ের আবার রাসনই বা কি মাতব্বর রাই বা কি ?ওই হেপো উগীর ঘরে আমি থাকবো না। পাখি আরও বলে — অঙ যার পাকা হয় অঙের নোকই পিথিবীর মধ্যে ছোট।

    পাখির রঙ পাকা হয়েছিল। করালীর পাশে পাশে সুখে দুঃখেও থেকেছে। বনওয়ারী করালী ও পাখির বিয়ের ব্যবস্থা করে গায়ে ফিরিয়ে এনেছে। বনওয়ারীর প্রবল আক্রমণ থেকে পাখি করালীকে সাধ্যমত রক্ষা করেছে। মামা হিসাবে বনওয়ারীকে যথাযোগ্য সম্মানও করেছে।

    তবু পাখির সুখে মাঝেমধ্যেই মেঘ দেখা দিয়েছে। বনওয়ারীর দল পাখি করালীর ঘর ভেঙে দিয়ে চন্দনপুরে চলে যেতে বাধ্য করেছে। পাখি করালীর অন্ধ সমর্থকের মত সেই কষ্ট সহ্য করেছে। আর পাঁচটা কাহার নারীর মতো পাখিও নিঃসন্তান থেকেছে। নয়ানের খাঁচা থেকে উড়ে গেলেও পাখি করালীর শেকলে বাঁধা পরে অটুট বিশ্বাসে এক নিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছে। তার প্রেমে পাপ নেই — জৈবতা নেই। পবিত্র প্রেমের সুগন্ধি কুসুম ফুটিয়ে পাখি উপকথায় বসনের ধারা বজায় রেখেছে।

    তবু শেষ রক্ষা হয়নি — আনন্দে উজ্জ্বল, ব্যবহারে অমায়িক পাখির জীবনেও শেষ পর্যন্ত নেমে এসেছে মর্মান্তিক ট্রাজেডি। করালী পাখির নিষ্ঠতার সম্মান দেয়নি। সুবাসীর যৌবন উন্মাদনার কাছে পাখি হেরে গেছে। করালীর পাখির প্রতিবাদে জানিয়েছে পৌষ মাসে ইঁদুর দশটা বিয়ে করে। তাই এখন পৌষ মাস সেও বিয়ে করবে। ‘ না পোষালে সরে পড় না কেনে ’। পাখি অভিমানাহিত বেদনায় করালীকে শেষ করে আত্মঘাতী হতে চেয়েছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে নিজেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সেই ভাবে ‘ করালীর কপালে পাখি চিরস্থায়ী দাগ এঁকে দিয়ে গিয়েছে। পাখিকে ভুলবার পথ রাখে নাই পাখি। ’

    উপকথার সোনার বরন হলুদমনি,বেনে বউ পাখি পাঠকের মনেও স্থায়ী দাগ রেখে দিয়েছে তার চরিত্রের কারণে সন্দেহ নাই। পাখির জীবনের মর্মান্তিক পরিণতি উপকথার উপকূলে স্থায়ী একটি বেদনার ঢেউ। নীলবাঁধে শালুকের বনে পাখি আর একটি শালুক উদয়াস্ত সূর্যমুখী।


এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রশ্নগুলি 

TAG ::  হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাস, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে সুচাঁদ, বাংলা উপন্যাস, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে গ্রাম সমাজের বিবর্তন, উপন্যাস, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলিবাঁকের উপকথা, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসে নসুবালা চরিত্র বিচার, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা চরিত্র, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা pdf download, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা প্রশ্ন। উত্তর, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা আলোচনা, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়