মেঘনাদবধ কাব্যে চতুর্থ সর্গের প্রয়োজনীয়তা | মেঘনাদবধ কাব্যের চতুর্থ সর্গের পরিকল্পনা

    উনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় মধুসূদনের আবির্ভাব। সে সময় বাংলাদেশের পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির জোয়ার বইছে।  সমগ্র জাতি তার পুরনো মূল্যবোধ অস্বীকার করে পাশ্চাত্য উন্নত দর্শনকে গ্রহণ করতে শুরু করেছে। নবজাগরণের শিক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে স্বতন্ত্র চিন্তার আশ্রয় নিয়ে মধুসূদন যুগ ধর্মের সাথে সঙ্গতি রেখে কাব্য সৃষ্টি ও অন্যান্য রচনায় আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি প্রথমেই এই অভিমত প্রকাশ করলেন যে তার মহাকাব্য রচনার উদ্দেশ্য পৃথক। মহাকাব্যের প্রধান গুন বিস্তৃতি। 

    মধুসূদন রামায়ণের যে অংশের কাহিনী থেকে তার কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছেন তাতে ঘটনার স্বল্পতা এই বিস্তৃতির পক্ষে অন্তরায়। তা বুঝতে পেরেই তিনি মেঘনাথ কাব্যের চতুর্থ স্বর্গের পরিকল্পনা করেছেন। এখন এই স্বর্গটি সম্পর্কে অভিযোগ ওঠে, এই স্বর্গটি কাব্যের মূল কাহিনী হতে বিচ্ছিন্ন এবং মূল প্রয়োজন সিদ্ধির পক্ষে নিরর্থক। কিন্তু এই অভিযোগ কতটা স্বীকার্য সে বিষয়ে আমরা অগ্রসর হতে পারি - 


   চতুর্থ সর্গের কাহিনী সংযোজনের উপযোগিতা সম্পর্কে কবি নিজেও চিন্তা করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে যে একে নিছক বাহুল্য মনে হতে পারে তা কবি নিজেও অনুভব করেছেন। তাই তিনি লিখেছেন -

     "Perhaps the episode of sita's (fourth  book ) should not have been admitted, since it is scarcely connected with the progress of the fable."


মেঘনাদবধ কাব্যে চতুর্থ সর্গের প্রয়োজনীয়তা


    তিনি আরো জানিয়েছিলেন - 

      "Many here look upon that Book as the best among the five." 

       এর থেকে বোঝা যায় চতুর্থ স্বর্গের সীতা সরমা কাহিনী একটি দরদ ঢালা সৃষ্টি। প্রথম স্বর্গে বীরবাহুর মৃত্যু শোক এবং রনদামামার মধ্যে মেঘনাদের সেনাপতি পদে অভিষেক, দ্বিতীয় স্বর্গে দেবতাদের কুট ষড়যন্ত্র এবং ইন্দ্রজিৎ হত্যার অস্ত্র লাভ, তৃতীয় স্বর্গে ইন্দ্রজিৎ পত্নী প্রমীলার বীর স্বামীর সঙ্গে সমাগম, আর পঞ্চম স্বর্গে ইন্দ্রজিৎ নিধনের উদ্যোগ এইভাবে ঘটনার ঘনঘটা। এরই মাঝখানে চতুর্থ স্বর্গে অশোক বনের স্নিগ্ধ নির্জন পরিবেশে দুই সখি সীতা ও সরমার সংলাপে দাম্পত্য জীবনের মধুময় কাহিনী।


মোটিভেশনাল গল্প পড়ুন


    সীতা সরমা র  কাহিনী বাল্মিকীর রামায়ণেও পাওয়া যায় কিন্তু তা উল্লেখ মাত্র। ভবভূতির উত্তর রামচরিত থেকে মধুসূদন এই স্বর্গের বিষয়বস্তুর কিছু উপকরণ পেয়েছেন। তবুও মধুসূদন দ্বিতীয়সের যে নির্ঝর ধারায় কাব্যটি সুস্নাত করেছেন তা উৎসারিত হয়েছে এই স্বর্গ থেকেই। শ্রদ্ধেয় সমালোচক মোহিতলাল যথার্থই বলেছেন : 

    "সে যেন তরঙ্গিত ক্ষুব্ধ সাগরের মধ্যস্থলে একটি স্তব্ধ শ্যামল প্রবাল দ্বীপ।"


     লক্ষ্য করলে দেখা যায় এই স্বর্গটির বিষয়বস্তু সীতা শরমার কথোপকথন মাত্র নয়। বর্তমানকাল থেকে কবি কিছুক্ষণের জন্য অতীতকালে চলে গিয়েছেন। কাব্যের কাহিনী কে সুসম্পন্ন করে তুলবার জন্য অতীতের ঘটনার উল্লেখ অপরিহার্য। এতে কাব্যে বিস্তৃতি এসেছে আবার এখানেই আমরা পেয়েছি সীতার অরণ্য জীবন কাহিনী, সুর্পনখা বৃত্তান্ত, রাক্ষস যুদ্ধ, রামের স্বর্ণমৃগ অন্বেষণ, রাবণ কর্তৃক সীতা হরণ, জটায়ুর যুদ্ধ এবং সেটার প্রতি সরমার সশ্রদ্ধ আশ্বাস বাণী। 


মেঘনাদবধ কাব্যে চতুর্থ সর্গের প্রয়োজনীয়তা


সীতাহরণ : 

     এখন এই স্বর্গটির উপযোগিতা সম্পর্কে প্রথমেই বলা যেতে পারে মেঘনাদের মৃত্যু কিংবা রাবণের লঙ্কা রাজ্যের ধ্বংসের মূল কারণটি হলো সীতা হরণ। এই মূল ঘটনাটিকে বাদ দিয়ে মহাকাব্যের ঘটনা সূত্রের গ্রন্থিমোচন আদৌ সম্ভব নয়। কবি মধুসূদন সীতা হরণের সেই অপরিচিত কাহিনীর সূত্রটি কবি উন্মোচন করেছেন এই স্বর্গে।


কাব্যের বৈচিত্র :

     দ্বিতীয়তঃ মহাকাব্যের অন্যতম প্রয়োজন হলো বৈচিত্র। তৃতীয় স্বর্গে কবি বীর রস ও ঐশ্বর্য আরম্বরের পর্যাপ্ত পরিবেশন করেছেন। বীরাঙ্গনা প্রমিলার চরিত্র অঙ্কন করবার জন্য বিরোচিত গতিবিধি বা কথাবার্তা র পাশাপাশি ভয়ঙ্কর এর সমাবেশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু মহাকাব্যের বৈচিত্রের প্রয়োজনে এই শান্ত শীতল পরিবেশ সংযোজনের গুরুত্ব ছিল। করুণ রস প্লাবিত চতুর্থসর্গটি সেই প্রয়োজনকে সিদ্ধ করেছে। অর্থাৎ বীর রসাত্মক কাব্যকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার জন্য যে মানসিক বিশ্রামের ( Dramatic relief ) প্রয়োজন তার সার্থক আয়োজন চতুর্থ সর্গ টি।


চরিত্রগত বৈপরীত্য :

    চরিত্রগত বৈপরীত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃতীয় স্বর্গের প্রমীলা কবির মানসী, সে বহ্নিশিখা। প্রমীলার প্রেমে কবি দেখিয়েছেন মিলনকে, আর সীতার প্রেমে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রশান্ত বিরহ কে। দুঃখ ও অশ্রুর উপাদানে কবির সীতা মূর্তির কল্পনা। সীতা জনমদুখিনী। রাম সীতার দণ্ডকারণ্য এর গার্হস্থ্য জীবনের পরিত্রতা সমস্ত কাব্য খানিকে এক অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে।


কাহিনীর নাটকীয়তা:

     চতুর্থত, কথোপকথন এর মধ্য দিয়ে কাহিনী বিন্যাস এমন নাটকীয় হয়ে উঠেছে যে তা সহজেই পাঠক চিত্তকে অভিভূত করে। কাব্যের মূল কাহিনী থেকে যদিও এই স্বর্গটি সাময়িক পশ্চাদপসরণ তবুও কাব্যিক রসময় এই কথোপকথন কাব্যে এক ঘনীভূত আবেদনের সৃষ্টি করেছে। এমনকি এখানেই তিনি তুলে ধরেছেন সীতা হরণের ফলে কি ঘটতে পারে সেই স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়টি।


উপসংহার: 

     পরিশেষে বলা যেতে পারে মহাকাব্যের বৈচিত্র সাধনের জন্য পার্শ্ব চরিত্র বা শাখা কাহিনীর বিশেষ প্রয়োজন। তাই সীতা শর্মার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে একটি বিচ্ছিন্ন আখ্যান বস্তুকে মূল ঘটনার সঙ্গে সংযোজিত করেছেন কবি। তাই বলা যেতে পারে কাব্য বিচারে এর প্রয়োজনীয়তা ছিল। প্রকৃতপক্ষে এই স্বর্গটি না থাকলে কাব্যটি অসম্পূর্ণতো থাকতই এমনকি এর প্রাণধর্ম পর্যন্ত ক্ষুন্ন হতো। 

TAG ::  মেঘনাদবধ কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য আবৃত্তি, মেঘনাদবধ কাব্য ব্যাখ্যা, মেঘনাদবধ কাব্য - naye natua ft. goutam halder, মেঘনাদবধ কাব্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্যের ছোট প্রশ্ন, কাব্য পাঠ, মেঘনাদবধ কাব্যের, মেঘনাদবধ কাব‍্য, মেঘনাদবধ কাব্য আলোচনা, মেঘনাদবধ কাব্যের মেঘনাদ চরিত্র, মেঘনাদবধ কাব্য বিশ্লেষণ, মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য সম্পূর্ণ, মেঘনাদবধ কাব্যের রস, মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য, মেঘনাদবধ কাব্য বীর রসে রচিত কী