ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবে রাজসিংহ কতখানি স্বার্থক তা আলোচনা করো।

   বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় তার রাজসিংহ উপন্যাস সম্পর্কে বলেছিলেন - এই প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম। সুতরাং তার লেখনীর এই বিশেষ অধ্যায় সম্পর্কে আলোচনা থেকে একথা আমরা ধরে নিতে পারি যে তার রাজসিংহ উপন্যাস টি বিশেষভাবে ঐতিহাসিক। তবুও সাহিত্যের সমালোচনার জগতে যেসকল সমস্যা সৃষ্টি হয় কোন সাহিত্যিক উপাদান নিয়ে সে দিক থেকে আমরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাজসিংহ উপন্যাস টি কে বিচার করে দেখব এই উপন্যাসটি সত্যিই ঐতিহাসিক কিনা।


   বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী, চন্দ্রশেখর, সীতারাম, এই সকল উপন্যাস গুলি ইতিহাসকে কেন্দ্র করে রচিত তবুও এদেরকে লেখক বার সমালোচক কখনোই প্রকৃত ঐতিহাসিক উপাদান বলে স্বীকার করেনি। পূর্বে উল্লেখিত বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব উক্তি এর সব থেকে জোরালো আবেদন বহন করে থাকে - আমি পূর্বে কখনো ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখি নাই, এমনকি তিনি এটাও বলেছেন যে - দুর্গেশনন্দিনী, চন্দ্রশেখর, সীতারাম কে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাইতে পারে না। 

ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসাবে রাজসিংহ কতখানি স্বার্থক তা আলোচনা করো।
রাজসিংহ

   লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজস্ব মতামত ও চিন্তা ধারা অনুযায়ী তাঁর রাশি ছিল প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস আর আমরা সে দিক থেকে রাজসিংহ উপন্যাস কে প্রকৃত বা যথার্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যায় কিনা তা দেখে নেব।


    কোন উপন্যাস কে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাবে কিনা, বা কোন উপন্যাস ঐতিহাসিক উপন্যাস কিনা সে বিচার করতে গেলে প্রথমে জানতে হবে যে ঐতিহাসিক উপন্যাস কাকে বলে এবং ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য গুলি কেমন। ঐতিহাসিক উপন্যাস বলতে আমরা বুঝি - 

   উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট শাখা যেখানে ইতিহাসের আঁধারে ব্যক্তিজীবন বা বিশেষ যুগের ঐতিহাসিক ঘাত-প্রতিঘাত কে রূপায়িত করা হয়, এবং মূল সমস্যা ঐতিহাসিক, এবং ঐতিহাসিক কাহিনী চরিত্রের নিয়ন্ত্রক হয় তাকে আমরা ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে থাকি। 


ঐতিহাসিক উপন্যাসের সংজ্ঞা অনুসারে ঐতিহাসিক উপন্যাসের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো - 


1. ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ইতিহাস থেকে উঠে আসে।

2. তবে ঐতিহাসিক উপন্যাসের চরিত্র গুলি ইতিহাস আশ্রিত নাও হতে পারে অর্থাৎ কাল্পনিক চরিত্র থাকতে পারে।

3. লেখক এর সমকালীন জীবনাদর্শ উপন্যাসে পরিস্ফুট হতে পারে।

4. ঐতিহাসিক উপন্যাসের কাহিনী ইতিহাসের পটভূমিকায় রচিত হয়। 

5. ঐতিহাসিক উপন্যাসে ঐতিহাসিক সত্যকেও অবশ্যই লেখক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। 


   ঐতিহাসিক উপন্যাসের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আমরা এখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রাজসিংহ উপন্যাস কে প্রকৃত ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাবে কিনা তা বিচার করে দেখব।


   রাজসিংহ উপন্যাস টি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা করেছেন রাজস্থানের রাজপুতদের গৌরব গাঁথা পটভূমিকায় মূলত হিন্দু জাতির বাহুবল দেখাবার জন্য। আর এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তিনি সিসোদিয়া রাজবংশের রাজসিংহ কে নির্বাচন করেছেন। 


    সুতরাং উপন্যাসের পটভূমি ঐতিহাসিক বলে এই উপন্যাসটিতে ঐতিহাসিক' উপন্যাস বলে দাবি করা যেতে পারে। যদি উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র গুলির কথা বলা যায় তবে দেখা যাবে সেখানে লেখক ওরঙ্গজেব, রাজসিংহজেবুন্নিসা প্রমূখ ঐতিহাসিক চরিত্র গুলির এক সমাবেশ ঘটিয়েছেন। 

   এমনকি এই সকল প্রধান চরিত্র গুলির সাথে সাথে অনেক গৌণ চরিত্রের দেখা মেলে যারা ইতিহাসের পটভূমিতে থেকে উঠে এসেছে। যেমন - উদি পুরি, ঔরঙ্গজেবের পুত্র দ্বিতীয় আকবর, চঞ্চল কুমারী, রূপনগরের রাজা বিক্রম সলাঙ্কি, সেনাপতি হুসেন আলি খা ইত্যাদি


   এই সমস্ত চরিত্র গুলির সাথে কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে লেখক মানিকলাল ও নির্মলকুমারী, দরিয়া ও মোবারক প্রভৃতি চরিত্র গুলি কে সৃষ্টি করেছেন। এই সকল কাল্পনিক চরিত্র গুলি ইতিহাসের ধারায় মিশ্রিত হয়ে গেছে বলে রাজসিংহ কে যথার্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে ধরা যেতে পারে।


   তবে রাজসিংহ উপন্যাস এ ইতিহাসের বহু তথ্য ঐতিহাসিক ভিত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে অনেক সমালোচক এই উপন্যাসটিতে ইতিহাসের উপর না বলে গ্রহণ করতে চাননি। তবে ঐতিহাসিক উপন্যাসের অন্যতম শর্ত ইতিহাসের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা সেখানে উপন্যাসিক ইতিহাসের যথার্থ থাকে না ও মূল্য দিতে পারেন।


   শুধু দেখতে হবে ইতিহাসের মূল ঘটনাটি উপন্যাসটিতে লেখক ঠিকভাবে চিত্রিত করেছেন কিনা। রাজসিংহ উপন্যাস টি কে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মূল ঘটনাটি বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসের অনুগত হয়ে বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি যে মানবিক সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। 


   ইতিহাসের কাহিনীর মধ্যে নির্মল কুমারীর কাছে ওরঙ্গজেব এর শূন্য হৃদয়ে বেদনার প্রকাশ, চঞ্চল কুমারীর রাজ সিংহের জন্য প্রতীক্ষার অবসান, জেবুন্নিসার শাহজাদী মর্যাদার ভুলুণ্ঠন ও মোবারক এর মত মনসবদারের প্রণয় এ সকল ঘটনা ইতিহাসের ধারায় মানবজীবন সত্য। এদিক দিয়ে বিচার করলে রাজসিংহ কে একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলাই যায়।


    বঙ্কিমচন্দ্র রচিত দূর্গেশ্ নন্দিনী, সীতারাম চন্দ্রশেখর উপন্যাস গুলি ইতিহাসের পটভূমিতে রচিত হয়েছে একথা ঠিক তবে উপন্যাসগুলি ইতিহাস দ্বারা চালিত হয়নি অর্থাৎ ইতিহাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। এই সকল উপন্যাস গুলিতে রোমান্টিক রসের বিস্তার ঘটেছে সাথে সাথে কল্পনাগুলো প্রাধান্য পেয়েছে অধিকতর। 


   এই অনুভূতি রাজসিংহ রচনা পর লেখক নিজেই অনুভব করেছেন তাই তার মত অনুসারে তোর রাজসিংহ উপন্যাস কে  বিচার বিশ্লেষণ করলে এটি যে একটি প্রকৃত ঐতিহাসিক উপন্যাস সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে না। 


👉👉  সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র রাজসিংহ উপন্যাস টি প্রকৃত ঐতিহাসিক উপন্যাস কিনা সে প্রশ্নের উত্তর উপরে আলোচনা করা হয়েছে এছাড়াও রাজসিংহ উপন্যাস সম্পর্কিত অন্যান্য প্রশ্নগুলি এখানে নিচে দেওয়া হল। 


এছাড়া বাংলা সাহিত্যের রূপ রীতি অনন্য প্রশ্নগুলি -\