বাংলা সাহিত্যে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ( BankimChandra ) চট্টোপাধ্যায় এর অবদান সম্পর্কে আলোচনা করো।

   বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার সূত্রপাত যাদের হাতে তাদের মধ্যে অন্যতম পথিকৃৎ মনীষী বঙ্কিমচন্দ্র ( BankimChandra ) চট্টোপাধ্যায়, উপন্যাসিক হিসাবে তিনি অধিক পরিচিত হলেও, প্রথিত যশা প্রাবন্ধিক ছিলেন তিনি। এখানে আমরা আজ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 


বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

পূর্বতন ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসের ক্ষীণতা, কল্পনা দৈন ও ভাবগভীরতার অভাবকে কাটিয়ে বাংলা উপন্যাসকে যিনি পূর্ণ যৌবনের শক্তি ও সৌন্দর্য দান করলেন তিনিই হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সবকটি উপন্যাসে জীবনের গভীর রস ও বিকাশগুলি ফুটে উঠেছে।

বাংলা সাহিত্যে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ( BankimChandra ) চট্টোপাধ্যায়
Educostudy.in/BankimChandra 


   জীবনের মর্মস্থলে গভীর রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। তিনি জীবনকে বিচিত্র রসে পূর্ণ এবিং কল্পনার ইন্দ্রজালে বেষ্টন করেছেন। কিন্তু সত্যের সূর্যালোকের পথ অবরুদ্ধ করেননি। রবীন্দ্রনাথ - বঙ্কিমের আবির্ভাবকে বিশ্লেষণ করেতে গিয়ে লিখেছেন-


বঙ্কিমচন্দ্র আনলেন সাত-সমুদ্রপারের রাজপুত্রকে আমাদের সাহিত্যে কন্যার পালঙ্কের শিয়রে। তিনি যেমনি ঠেকালেন সোনার কাঠি অমনি সেই বিজয় বসন্ত, লায়লা-মজনুর হাতির দাঁতে বাঁধানো পালঙ্কের উপর নড়ে উঠল। চলতি কালের সঙ্গে তার মালাবদল হয়ে গেল। তারপর থেকে তাকে আজ আর ঠেকিয়ে রাখে কে?”


বঙ্কিমচন্দ্র মোট ১৪টি উপন্যাস লিখেছেন। কালানুক্রমিক পর্ব বিভাজন করে আমরা উপন্যাসগুলি আলোচনা করতে পারি।

বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস জীবনের প্রথম পর্বের উপন্যাসগুলি হল – ‘দুর্গেশনন্দিনী’, জগৎসিংহ-আয়েষা-ওসমান এবং বীরেন্দ্রসিংহ-বিমলা-কতলু খাঁ’র কাহিনী নিয়ে রচিত। যে পথ দিয়ে বঙ্কিমের অশ্বারোহী পুরুষটি অশ্বচালনা করেছিল তা বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের প্রথম রাজপথ। জগৎসিংহের কড়া নাড়ায় দেবমন্দিরের সঙ্গে পাঠকেরও হৃদয়দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল। জগৎসিংহ ও বঙ্কিম একযোগে সেখানে প্রবেশ করেছিল।


কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে প্রকৃতি-দুহিতা কপালকুণ্ডলা কিভাবে নবকুমারকে ভালোবেসে সামাজিক জীবনে বাঁধা পরে দুর্জ্ঞেয় নিয়তি নির্দেশে ধীরে ধীরে নিয়তি পরিণামের দিকে এগিয়ে গেল তা বঙ্কিম অপূর্ব দক্ষতায় বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসটিতে রোমান্সের লক্ষণ প্রবল। সর্বোপরি এক ক্রুদ্ধ দৈবশক্তির সুস্পষ্ট অঙ্গুলিসঙ্কেত লক্ষ করা যায়। তাই মনে হয় কপালকুণ্ডলা Magic hand of chance এর অপার্থিব কীর্তি।


এর তিন বছর পর প্রকাশিত ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসটি শ্লথ বন্ধন। উপন্যাসটি ঐতিহাসিক তথ্যনির্ভর নয়, ঐতিহাসিক কল্পনা সঞ্জাত। তবে হেমচন্দ্র-মৃণালিনী-পশুপতি প্রভৃতি চরিত্রের মধ্যে স্বনিয়ন্ত্রিত মানব মনের বিচিত্র চাওয়া-পাওয়া, আকর্ষণ-আঘাত সার্থক প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে – এখানেই লেখকের কৃতিত্ব।


বঙ্কিমের দ্বিতীয় পর্বের (১৮৭৩-৭৮) উপন্যাসগুলি হল ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩), ‘ইন্দিরা’ (১৮৭৩), ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪), ‘চন্দ্রশেখর’ (১৮৭৫), ‘রজনী’ (১৮৭৭), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮) । ‘বিষবৃক্ষ’ এবং ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ দুটি উপন্যাসেরই মূল সমস্যা অনিবার্য রূপ-তৃষ্ণা, রমনী রূপমুগ্ধ পুরুষের প্রবৃত্তি দমনে অক্ষমতা। তাই কৃষ্ণকান্তের উইলে গোবিন্দলাল রোহিনীকে গ্রহণ করেই জেনেছে-


“এ রোহিনী, ভ্রমর নহে – এ রূপতৃষ্ণা, এ স্নেহ নহে, সুখ নহে – এ মন্দার ঘর্ষণ-পীড়িত বাসুকি – বাসুকি নিঃশ্বাস নির্গত হল, এ ধন্বন্তরি ভান্ড নিঃসৃত সুধা নহে।”


কিন্তু তবুও নীলকন্ঠের মত গোবিন্দলাল সে বিষ পান করে, ফলে তাদের জীবনে নেমে এসেছে ট্র্যাজেডি। আবার এই কারণে বিষবৃক্ষতে নগেন্দ্র-কুন্দনন্দিনী-সূর্যমুখীর জীবন-সমূদ্র হলাহলোৎপত্তি হয়েছে। বঙ্কিম তাই উপন্যাসের শেষে আশা রেখেছে-


“আমরা বিষবৃক্ষ সমাপ্ত করিলাম। ভরসা গৃহে গৃহে অমৃত ফলিবে।”


ইন্দিরা’ উপন্যাসে ইন্দিরার দস্যুর হাতে অপহরণের পর স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলনের নানা কৌশলই প্রধান উপজীব্য। এর সঙ্গে বাঙালীর সংস্কারজীর্ণ গৃহকোণের রোমান্সটুকু আবিষ্কার করে বঙ্কিম হয়ে উঠেছে স্রষ্টা ও আবিষ্কারক।


যুগলাঙ্গরীয়’ একটি প্রেমের রোমান্টিক বড় গল্প মাত্র। কাহিনী, চরিত্র কোনোদিক থেকেই এতে উপন্যাসের লক্ষণ ফুটে ওঠেনি।


চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসটি মীরকাশিম ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দ্বন্দ্বের পটভূমিতে তৈরি। চিত্ত সংযমে অসমর্থা শৈবলিনীর মানসিক নরকযন্ত্রণা, প্রতাপের আত্মসংযমের অসাধারণ আদর্শ, চন্দ্রশেখরের আদর্শ চরিত্র এই তিনটি পারিবারিক চরিত্রের চিত্র স্থাপন করে বঙ্কিম তার নিজস্ব নীতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন।


এরপর ‘রজনী’ উপন্যাসে রজনী চরিত্রটি লিটনের ‘The Last Days of Pompeii’ উপন্যাসের নিদিয়ার চরিত্রের সঙ্গে মিল আছে। রজনীর প্রেমমধুর হৃদয়মাধুর্য, লবঙ্গলতার প্রেম জগতের তীব্র, গভীর দ্বন্দ্ব, অমরনাথের ত্যাগদীপ্ত পৌরুষ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বঙ্কিম প্রথম বাংলা সাহিত্যে মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণমূলক উপন্যাস উপহার দিয়েছেন।


বঙ্কিমের তৃতীয় পর্বের (১৮৮২-৮৭) বা শেষ পর্বের উপন্যাসগুলি হল ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২), ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮৪), ‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৪), ‘রাধারাণী’ (১৮৮৬), ‘সীতারাম’ (১৮৮৭) । ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসকে বঙ্কিমচন্দ্র ঔরঙ্গজেব-চঞ্চলকুমারী-রাজসিংহ কাহিনীর ঐতিহাসিকতার মধ্যে জেব-উন্নিসা-মোবারক-দরিয়ার কল্পনাপ্রসূত উপকাহিনীকে মিশিয়ে সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস তৈরি করেছেন। এখানে ইতিহাসের বাঁধা পথ তার কল্পনাকে গ্রাস করেনি।


আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমের স্বদেশচিন্তা পূর্ণ প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মধ্যে জাতপাতের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। তাই সত্যানন্দ বলেছিল-


“তোমরা জাতি ত্যাগ করিতে পারিবে? সকল সন্তান একজাতীয় এ মহাব্রতে ব্রাহ্মণ, শূদ্র বিচার নাই।”


এরসঙ্গে তিনি ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্র উচ্চারণ করে বৈষ্ণোবোচিত ভক্তিযোগ ও ক্ষত্রিয়োচিত শক্তিযোগের মধ্য দিয়ে কর্মসন্ন্যাসের সাধনা করেছিলেন। সমকালীন ভারতবর্ষীয় জীবনে যার প্রস্তুতি চলছিল।


দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসে দেবী চৌধুরাণীর মধ্যে ব্যক্তিত্বের মানস সম্ভাবনা ছিল ঘনতম। ভবানী পাঠকের আজীবন অনুসন্ধানের সিদ্ধি প্রফুল্লের সহজ ব্যক্তিত্ব। এই ব্যক্তি স্বভাবের চরম সার্থকতা বিহিত হয়েছে তখন, যখন বঙ্কিম জনকল্যানের বৃহত্তম জীবনবেদীতে দেবী চৌধুরাণীকে স্থাপন করে আহ্বান জানিয়েছে-


“এসো এসো প্রফুল্ল। একবার লোকালয়ে দাঁড়াও – আমরা তোমায় দেখি।”


রাধারাণী’ উপন্যাসে একটি দুঃস্থ বালিকা কিভাবে রুক্মিনীকুমার ছদ্মনামধারী ধনাঢ্যের সহৃদয়তায় দারিদ্র থেকে মুক্তিলাভ করল এবং পরে তারই সঙ্গে পরিণয়াবদ্ধ হল তাই বর্ণিত হয়েছে।


আত্মহত্যায় অন্ধ রেনেশাঁ যুগের বাঙালীকে আত্মরক্ষা, আত্মপ্রসারের জীবনমন্ত্রে ঋগ্ধ করেই বঙ্কিম ‘সীতারামের’ আত্মনাশী পরিণামকে মহামৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন।


বাংলা উপন্যাসকে প্রথম শৈশব থেকে যৌবনে উত্তরণকারী সাহিত্যসম্রাট হলেন বঙ্কিম। তাই তাঁর উপন্যাসে কিছু বৈশিষ্ট্য সহজপ্রাপ্য-


১) বঙ্কিমের যুগ ছিল আত্মমুক্তি ও আত্মপ্রতিষ্ঠার যুগ। তাই যুগজীবন বেদনা তাঁর উপন্যাসে স্থান পেয়েছে।


২) বঙ্কিমের উপন্যাসে নায়িকাদের একান্ত প্রতিযোগিতামূলক প্রেমিকা-স্বভাব লক্ষ্যণীয়।


৩) বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সার্থক মিলন ঘটিয়েছেন।


৪) আত্মহত্যায় অন্ধ রেনেশাঁ যুগের বাঙালীকে আত্মরক্ষা, আত্মপ্রসারের জীবনমন্ত্রে ঋগ্ধ করেই বঙ্কিম তাকে দিয়েছেন চূড়ান্ত মুক্তি।


৫) বঙ্কিমের উপন্যাস জগত অসাধারণ রূপের জগত। আবার রূপচিত্রণের মধ্য দিয়ে স্বভাবের মূলও খুঁজতে চেয়েছেন তিনি।


৬) বঙ্কিমের উপন্যাসে প্রেমবাসনা আদর্শের দ্বারা সংযমিত হয়েছে।


৭) জ্যোতিষের ভবিষ্যৎবাণীর প্রভাব তাঁর উপন্যাসে লক্ষ্যণীয়।


৮) চিঠির সাহায্যে মনের সচেতন স্তরের ব্যাখ্যা, স্বপ্নের মধ্য দিয়ে তির্যক ভঙ্গিতে মনের গোপন স্তরের উদ্ঘাটন বঙ্কিমের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য।


৯) বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের ভাষা অতিসচেতন মননের ফল।


১০) বঙ্কিম ডিকেন্সের মত বাঙালী জীবনের অন্তর্নিহিত নাটকীয় গুণকে ব্যবহার করেছেন তাঁর উপন্যাসে।


১১) তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসে ইতিহাসের তথ্যের মধ্যে মানবিক হৃদয়বৃত্তির কাহিনী সমান্তরালভাবে অবস্থিত।


১২) স্বদেশানুরাগ তাঁর উপন্যাসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার অন্যতম নিদর্শন ‘বন্দেমাতরম্’ মন্ত্রটি।


বাংলা উপন্যাসকে যৌবন মন্ত্রে দীক্ষা প্রদানকারী সাহিত্যিক হলেন বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিম প্রথম আধুনিক উপন্যাসের স্রষ্টা। তিনি তাঁর জ্ঞান সাধনার, জীবন সাধনার তীর্থক্ষেত্র থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় উপলখণ্ড। আর এই উপলখণ্ড তিনি বিছিয়ে দিয়েছিলেন অনাধুনিক বাংলা উপন্যাসের মেঠো পথে। ফলে যে রাজপথ সৃষ্টি হল তার উপর দিয়ে ভবিষ্যতের উপন্যাসিকদের বহুগুণ ভারী রথও চলে গেছে অনায়াসে। তাই আধুনিক উপন্যাস সৃষ্টির প্রথম ধ্যানী মহাপুরুষ হলেন বঙ্কিমচন্দ্র। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য গুরুত্ব পূর্ন প্রশ্ন ও উত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন, ধন্যবাদ।।