বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে প্রমথ চৌধুরীর অবদান আলোচনা করো - Educostudy

   আধুনিক বাংলা সাহিত্য জন্ম হতেই শক্ত - পক্ত হয়ে উঠতে পারেনি, বিভিন্ন পরিবর্তন পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য আধুনিক আর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আজকের বর্তমান অত্যাধুনিক সাহিত্যে রূপান্তর। 

প্রমথ চৌধুরীর অবদান আলোচনা করো
Educostudy.In/Pramatha-Chowdhuri


    আধুনিক বাংলা সাহিত্য প্রাচীন - মধ্য যুগের অনেক খোলস ত্যাগ করে চলিত ভাষায় নতুন রূপ পেয়েছিল। আর বাংলা ভাষা যার হাতে এই চলিত ভাষায় নতুন দিক পেয়েছিল তিনি প্রমথ চৌধুরী ( Pramatha Chowdhuri )। আজ আমরা এই প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিকের বিভিন্ন অবদান ও গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করবো।


প্রমথ চৌধুরীর অবদান


জন্ম – ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দ | মৃত্যু – ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দ | ছন্মনাম – বীরবল


  রবীন্দ্রপর্বের দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুণী মানুষটির নাম প্রমথ চৌধুরী। ‘সবুজপত্র’ নামে একটি চলিত ভাষা ভিত্তিক মাসিকপত্র সম্পাদনা করে বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘বীরবলী-ঢং’-এর গদ্যরীতির প্রবর্তন করেন। সবচেয়ে বড় কথা রবীন্দ্র সমকালে, রবীন্দ্রস্নেহধন্য হয়েও গদ্য ভাষা লেখার ক্ষাত্রে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত ছিলেন তিনি।


  বলিষ্ঠ সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব আর শাণিত বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্যে বাংলাগদ্যে এক অভিনব style এনেছেন তিনি। মনে রাখা দরকার উনিশ শতকে ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এ পারীচাঁদ মিত্র আর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য় কালীপ্রসন্ন প্রথম চলিত গদ্য রীতি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এই ভাষা ও রীতির মধ্যে সৌন্দর্যবোধের যথেষ্ট অভাব ছিল।


  বিশ শতকে প্রমথ চৌধুরীই সেই আলালী ভাষার উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে সুমার্জিত রূপ ও রীতি দান করলেন। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন-


“তোমার গদ্যপ্রবন্ধ সবগুলিই পড়েছি। তোমার কবিতার যে গুণ তোমার গদ্যেও তাই দেখি – কোথাও ফাঁক নেই এবং শৈথিল্য নেই, একেবারে ঠাস বুনানী।” (চিঠিপত্র, পঞ্চমখণ্ড, বিশ্বভারতী)

প্রমথ চৌধুরীর রচিত গ্রন্থগুলিকে এভাবে সাজানো যায়-


১) তেল, নুন, লক্ড়ি – ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দ


২) বীরবলের হালখাতা – ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দ


৩) নানাকথা - ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দ


৪) আমাদের শিক্ষা - ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দ


৫) দু-ইয়ারকি - ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ


৬) বীরবলের টীপ্পনী - ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ


৭) রায়তের কথা - ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দ


৮) নানা চর্চা - ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দ


৯) ঘরে-বাইরে - ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দ


১০) প্রাচীন হিন্দুস্থান - ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দ


১১) বঙ্গসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় - ১৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দ


১২) আত্মকথা - ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দ


১৩) প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান - ১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দ


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য প্রমথ চৌধুরীর এক বিষয়ক কিছু প্রবন্ধ বিভিন্ন প্রবন্ধগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। (পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী থেকে নির্বাচিত ৫০টি প্রবন্ধ ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ নামে দুইখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে)


সাহিত্য অনুরাগী মনস্বী ব্যক্তি প্রমথ চৌধুরী ইংরাজী ও ইউরোপীয় অন্যান্য সাহিত্যের সুপাঠক ছিলেন। বিশেষত ফরাসী সাহিত্যের প্রতি তার অসামান্য ব্যুৎপত্তি ছিল বাংলা সাহিত্যে ফরাসী গদ্যের প্রসাদগুণ, সংযম ও বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণতা তিনিই আনয়ন করেন।


   এই বিচিত্র ভঙ্গিতে সাহিত্য, শিক্ষা, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, বিজ্ঞান ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। সেগুলি মূলত ‘সবুজপত্রে’ প্রকাশিত হত। ভাষা শিল্পী হিসাবে চলিত ভাষার যোগ্যতা, তার সাহিত্যিকরূপ ও রীতি অবলম্বন করে কয়েকটি সারগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছিলেন।


কথারকথা’, ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’, ‘আমাদের ভাষা সংকট’, ইত্যাদিতে তিনি বাংলা ভাষার যুগোপযোগী কাঠামো নির্মাণের দায় স্বীকার করেছেন। ‘কথারকথা’ প্রবন্ধে বলেছেন-


“যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ প্রাণ।” (প্রবন্ধ সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড, বিশ্বভারতী)


সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’ প্রবন্ধেও প্রা অনুরূপ কথা বলেছেন তিনি-


“তথাকথিত সাধুভাষা সম্বন্ধে আমার প্রধান আপত্তি এই যে ওরূপ কৃত্রিম ভাষায় আর্টের কোন স্থান নেই।”


আসলে তিনি যে ধরণের পরিহাসপ্রিয় ও উপভোগ্য বিষয় নির্বাচন করতেন, তাতে চলিত ভাষাই বেশি গ্রহণোযোগ্য।


সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক তার ভাবনাগুলি প্রকাশ পেয়েছে ‘সাহিত্যে খেলা’, ‘সাহিত্যে চাবুক’, ‘খেয়াল খাতা’, ‘কাব্যে অশ্লীলতা’, ইত্যাদি প্রবন্ধে। সাহিত্য-শিল্পাদর্শের ক্ষেত্রে তিনি ‘Art for Art’s sake’ (কলাকৈবল্যবাদ) নীতিকে গ্রহণ করেছেন। তার মতে সার্থক কবিত্ব বা শিল্পত্ব বিশুদ্ধ আনন্দের লীলাবৈচিত্র্য থেকে উদ্ভুত।

 

 ‘বস্তুতন্ত্রতা বস্তুকি’ নামক প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্য আদর্শ ও সাহিত্য চিন্তার বিশিষ্ট পরিচয় রয়েছে। তিনি Realism ও Idealism-এর স্বরূপ ব্যাখ্যা করে উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্দেশ করেছেন উক্ত প্রবন্ধে।


বিতর্কমূলক সাহিত্যতত্ত্বে বীরবলী ভাষা ও প্রকাশরীতি বিশেষ সাহায্যকারী। ‘জয়দেব’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘ভারতচন্দ্র’, ‘বঙ্গসাহিত্যের নবযুগ’ প্রভৃতি প্রবন্ধে তার তীক্ষ্ণ রসগ্রাহিতা ও গঠনমূলক অভিভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। ‘চিত্রাঙ্গদা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা বিষয়ে Thomson-এর সমালোচনার বিরুদ্ধতা করেছেন লেখক। বলেছেন-


“চিত্রাঙ্গদা একাধারে কাব্য, চিত্র ও সঙ্গীত; অতএব তা চরম কাব্য। কেননা চিত্রাঙ্গদায় আর্টের ত্রিধারার পূর্ণ মিলন হয়েছে।” (প্রবন্ধ সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড)


সমালোচনার ক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর এই দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট গঠনমূলক ও নন্দনতত্ত্ব স্বাপেক্ষ। ভারতচন্দ্রের কাব্যের মধ্যেও প্রকৃত শিল্পীসত্ত্বা আবিষ্কার করেছেন লেখক। ‘বঙ্গসাহিত্যে নবযুগ’ প্রবন্ধে সমকালীন ও পূর্ববর্তী লেখকদের মননশীলতা ও রচনারীতির বিশ্লেষণ রয়েছে।


শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতেও নিজস্ব চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ রেখেছেন লেখক। ‘আমাদের শিক্ষা’, ‘বইপড়া’, ‘শিক্ষার নব আদর্শ’, ‘নববিদ্যালয়’ প্রভৃতি প্রবন্ধে জাতীয় শিক্ষার ত্রুটি বিচ্যুতি ও শিক্ষা সংস্কারের মনোজ্ঞ পথ নির্দেশিত হয়েছে। ‘বইপড়া’ প্রবন্ধে তিনি বলছেন যে অতীত ও বর্তমানের ভাবপ্রবাহের সংযোগ সেতু হল গ্রন্থ। এজন্যে তিনি লাইব্রেরী স্থাপনের উপর জোড় দিয়েছেন। বলছেন-


“শিক্ষকের সার্থকতা শিক্ষাদান করায় নয়, কিন্তু ছাত্রকে তা অর্জন করতে সক্ষম করায়।” (প্রবন্ধ সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড)


এই বক্তব্যের সঙ্গে বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ এমনকি রুশোর শিক্ষা চিন্তার মিল রয়েছে।


তেল-নুন-লক্ড়ি’, ‘দু-ইয়ারকি’, ‘রায়তের কথা’, ‘ঘরে বাইরে’ প্রভৃতি প্রবন্ধগুলি তার রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সামাজিক জীবন-গবেষোণার দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত। বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে কৃষকদের প্রতি যে সহানুভূতি দেখিয়েছেন বিশ শতকে সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন কিছুই প্রায় না হওয়ার কারণ বলে তিনি দায়ী করেছেন দেশীয় Politics-কে। এজাতীয় প্রবন্ধগুলি যেমন সরস তেমনই সুখপাঠ্য, অনেকটা treatise জাতীয় রচনা। ‘নানাচর্চা’ গ্রন্থে অনেক ঐতিহাসিক প্রসঙ্গের বিশ্লেষণ করেছে বীরবল।


তার আত্মজীবনীভিত্তিক প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আত্মকথা’। এই গ্রন্থে শৈশবকাল থেকে ইংল্যাণ্ড যাত্রার পূর্ব পর্যন্ত বহু ঘটনা আত্ম-বিবৃতির আকারে বর্ণিত। সামকালীন দেশের বিচিত্র পটভূমি, বিশিষ্ট সামাজিক গণের পরিচয় অবশ্য এখানে খুব বেশি আসেনি। লেখার মধ্যে যে অসংলগ্নতা রয়েছে সে বিষয়ে সচেতন রয়েছেন তিনি। তাই ‘কৈফিয়ত’ অংশে বলেছেন-


“আত্মকথা লিখতে আরম্ভ করি অতি দুঃসময়ে, রবীন্দ্রনাথ তখন একটি কঠিন রোগে আক্রান্ত। পরে তিনি সে ফাঁড়া কাটিয়ে উঠলেন। তারপর ১৯৪১ সালে উপর্য্যুপরি আমার নানারকম দুর্ঘটনা ঘটতে লাগল।”


এই অস্থির মানসিকতা সত্ত্বেও তার দৃষ্টিকোণের মৈলিকত্ব ও রচনারীতি এইরকম সুখপাঠ্য থেকেছে। সমালোচক অতুলচন্দ্র গুপ্তের কথায় এই আত্মকথা সাহিত্য সিহাবে তার ছোটগল্পের মতই তীক্ষ্ণ ও রসাল।


বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর মত এত বুদ্ধিদীপ্ত লেখন ভঙ্গি আর কাররই প্রায় ছিল না। প্যারীচাঁদ, কালীপ্রসন্ন থেকে বাংলাগদ্যে যে আধুনিক চলিত রীতির প্রবর্তন শুরু হয় প্রমথ চৌধুরীই তার যথার্থ তরণীবাহক। ‘সবুজপত্রের’ সম্পাদনা করে বাংলা সাহিত্যের জগতে তিনি রবীন্দ্রনাথকেও উৎসাহিত করেছিলেন চলিত ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্যে।


   সেকথা স্বীকারও করেছেন বিশ্বকবি। ফরাসী সাহিত্যিক মোঁপাসার Sanity ও চার্লস ল্যাম্বের Humouristic মেজাজকে আত্তীকরণ করে বাংলা গদ্যে তীক্ষ্ণ মননশীলতার প্রবর্তন করেন তিনি। পরবর্তীকালে অন্নদাশঙ্কর রায়, মুজতবা আলি কিংবা তারাপদ রায়ের মত লেখকরা এই ধারাতে নিস্নাত হয়ে বাংলা গদ্যের উৎকর্ষ-মুখকে মোহনার দিকে নিয়ে গিয়েছেন।


প্রবন্ধ গ্রন্থ

তেল-নুন-লক্ড়ি – ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দ


বীরবলের হালখাতা – ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দ


নানাকথা – ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দ


আমাদের শিক্ষা – ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দ


দু’ইয়ারকি – ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ


বীরবলের টিপ্পনী – ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দ


রায়তের কথা – ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দ


নানাচর্চ্চা – ১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দ


ঘরে বাইরে – ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দ


প্রাচীন হিন্দুস্থান – ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দ


বঙ্গ সাহিত্যের পরিচয় – ১৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দ


আত্মকথা – ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দ




প্রবন্ধ সংগ্রহ

হিন্দু সংগীত – ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দ



অন্যান্য প্রবন্ধ


জয়দেব – ভারতী ও বালক – জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭ বঙ্গাব্দ


আমাদের ভাষাসঙ্কট – সবুজপত্র – জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ১৩২৯ বঙ্গাব্দ


বর্ষা – সবুজপত্র – জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় – ১৩২৯ বঙ্গাব্দ


বর্ষার দিন – বিচিত্রা – ভাদ্র ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ


চিত্রাঙ্গদা – বিচিত্রা - চৈত্র ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ


কাব্যে অশ্লীলতা – আলংকারিক মত – মাসিক বসুমতী


👉👉   উপরে আমরা প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর অবদান, ও বিভিন্ন গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এছাড়া বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সম্পর্কে আলোচনা করেছি প্রয়োজনে আমাদের এই সকল প্রশ্ন গুলি দেখতে পারেন।