উপন্যাস জগতে রবীন্দ্রনাথ (RabindraNath Tagore) ঠাকুরের অবদান সম্পর্কে আলোচনা।

 গীরি কন্দরে বারি রাশি যেমন সঞ্চিত থাকে তার পর কোনো এক শ্রেষ্ঠ মুহূর্তে বিশালকায় জলরাশি নিয়ে যাত্রাপথের অভিমুখে গমন করে, বাংলা সাহিত্য তার সন্তান সম রবীন্দ্র নাথকে নিয়েও সেই অভিপ্রায়ে গমন করেছিল। আর সেই গমন পথের দুকূল প্লাবিত হয়ে আজকের বাংলা সাহিত্য শস্য শ্যামল হয়ে উঠেছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ (RabindraNath Tagore)  হাত দেয়নি এমন কোনো সাহিত্যের শাখা নেই। আজ আমরা এখানে রবীন্দ্রনাথকে উপন্যাস জগতের অন্যতম নক্ষত্র রূপে তুলে ধরবো। 



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বঙ্কিমের দ্বারা বাংলা উপন্যাসের যে পথ নির্দেশিত রবীন্দ্রনাথই প্রথম তাকে যথাযথভাবে আধুনিক পদবাচ্য করে তার ভবিষ্যতের গন্তব্যটি চিহ্নিত করে দিয়েছেন। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাঙালী সমাজ অনিবার্য বৈনাশিকতাবোধের এক নিরেট অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। তাই রবীন্দ্রনাথ এই অস্থির অন্ধকার চেতনার মুখোমুখি হতে চেয়েছেন তাঁর ঘন গম্ভীর জীবন সম্পৃক্ত অনুভাবনার পুঁজি নিয়ে।


   তিনি প্রতিদিনের গ্লানি ও বিরোধ সবিস্তারে বর্ণনা করে পাঠকের মনে বাস্তবতার ভাবটি দৃঢ়তর ভাবে মূদ্রিত করে দিয়েছেন। আবার তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের বহির্জগতে চাঞ্চল্য ক্রমেই সংযত ও সংহত হয়েছে। এবং বিক্ষোভ, জটিলতা, অন্তর্দ্বন্দ্বে মথিত অন্তর্লোককে ক্ষত-বিক্ষত, ক্রিয়াশীল ও সমন্বয় সচেষ্ট করে তুলেছে। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথের বিশিষ্টতা।


রবীন্দ্র উপন্যাসের যাত্রা আরম্ভ হয় ‘করুণা’ (১৮৭৭-৭৮) দিয়ে, কিন্তু এটি তাঁর অসম্পূর্ণ প্রয়াস। তাই এটিকে ঠিক উপন্যাসের পর্যায়ে ফেলতে চাননা অনেক সমালোচক।


উপন্যাস জগতে রবীন্দ্রনাথ (RabindraNath Tagore) ঠাকুরের অবদান
Educostudy/RabindraNath Tagore


করুণা’-কে বাদ দিলে কালানুক্রমিক বিচারে তাঁর উপন্যাস রচনার স্পষ্ট চারটি কালব্যবধানের পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্বের (১৮৮৩-৮৭) রচিত দুটি উপন্যাস হল ‘বউঠাকুরানীর হাট’ (১৯৮৩) এবং ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭)। বাংলার রাজা প্রতাপাদিত্য, ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমানিক্যকে নিয়ে রচিত উপন্যাস দুটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। কিন্তু উপন্যাস হিসাবে এগুলি ততটা সার্থক উপন্যাস নয়।


রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পর্বের (১৯০৩-১০) উপন্যাসগুলি হল ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬) এবং ‘গোরা’ (১৯১০)। রবীন্দ্রনাথের দুঃসাহসিক এবং সফলতম উপন্যাস ‘চোখের বালি’-তে নৈতিক বিচার অপেক্ষা তথ্যানুসন্ধান ও মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণই লেখকের প্রধান লক্ষ্য। মহেন্দ্র-আশা-বিনোদিনী-বিহারী এই চারজনের প্রেমের গূঢ় আকর্ষণ-বিকর্ষণ লীলার মধ্যে তাদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে তিনি আধুনিকতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। তাইতো তিনি লিখতে পেরেছেন-


“ক্ষুধিত হৃদয়া বিনোদিনীও নববধূর নবপ্রেমের ইতিহাস মাতালে জ্বালাময় মদের মত কান পাতিয়া পান করিতে লাগিল।”


এখানে এই অবৈধ প্রেম বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে নৈতিক অনুশাসনে নয়, নিজের অন্তর্নিহিত শোভনতা ও আত্মপোলব্ধির দ্বারা। আবার বিহারী-বিনোদিনীর প্রেমে প্রেমের সনাতন সৌন্দর্য ও মহিমা সগৌরবে বিঘোষিত হয়েছে। ‘চোখের বালি’ এই নতুন পুরাতনের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে এক হাতে বঙ্কিমচন্দ্র, অন্যহাতে শরৎচন্দ্রের যুগকে নিবিড় ঐক্যবন্ধনে বেঁধেছে।


নৌকাডুবি’ (১৯০৬) উপন্যাসটি রোমান্সের একটি বিস্ময়কর সংঘটনের উপর প্রতিষ্টিত। হেমনলিনী-রমেশ-কমলা-নলিনাক্ষ এদের কাহিনীতে মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্মতা রক্ষিত হয়নি, কিন্তু বাস্তব প্রধান উপন্যাস হিসাবে এটি উল্লেখযোগ্য। এরপর মহাকাব্যধর্মী উপন্যাস ‘গোরা’ (১৯১০) একই সঙ্গে ভারতভাবনা রূপায়ন ও জীবনধর্মী কাহিনী।


  হিন্দুধর্মের আবেগতত্ত্ব প্রতিনিধি গোরা অনেক ঠেকে জানতে পেরেছে ব্যক্তি জীবনের বিসর্জনে নয়, প্রতিষ্ঠায় জীবনের সার্থকতা। সে বুঝেছে রোমান্টিক স্বদেশপ্রেম ও রোমান্টিক ব্যক্তিপ্রেম এই দুটি পরস্পরের পরিপূরক। তাই সে তার ভালোবাসা সুচরিতার কথা মনে মনে চিন্তা করে বলেছে-


“যে আমারই তাহাকে আমি লইব। নহিলে পৃথিবীতে আমি অসম্পূর্ণ-আমি ব্যর্থ হইয়া যাইব।”


তাই গোরা দেশপ্রেমের, মানবিকপ্রেমের, ভারতভাবনার, জীবনভাবনার উপন্যাস।


বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য গুরুত্ব পূর্ন প্রশ্ন ও উত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন


চতুরঙ্গ’, ‘ঘরে বাইরে’ রবীন্দ্রনাথের তৃতীয় পর্বের রচনা (১৯১৫)। বিশেষ থেকে নির্বিশেষে, বহির্জগত থেকে ভিতর দেহলিতে প্রত্যাবর্তনের প্রথম শিল্পরূপ ‘চতুরঙ্গ’। ব্যক্তিচরিত্রের সর্বময় প্রতিষ্ঠা ও চরিত্রের জন্মান্তর তথা রূপান্তরই লেখকের দুটি প্রধান লক্ষ্য। এখান থেকে বিবৃতি বিশ্লেষণ দূর হয়ে সংকেতবহ তির্যক বাক্-ভঙ্গিমায় আঁতের কথাকে আঁতের গভীরে সঞ্চারিত করে দেবার এক নতুন কলা-কৌশল গড়ে উঠল।


ঘরে বাইরে’ (১৯১৫) উপন্যাসে নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপ এই তিন চরিত্রের আদর্শবাদ ও বস্তুবাদ, স্বপ্ন ও বাস্তব, শ্রেয় ও প্রেমের দ্বন্দ্ব সূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে।


রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস রচনার শেষ পর্বের উপন্যাসগুলি হল ‘যোগাযোগ’, শেষের কবিতা’, ‘দুইবোন’, ‘মালঞ্চ’, ‘চার অধ্যায়’। ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯) উপন্যাসটি নিছক পারিবারিক কাহিনী নয়, এখানে মুখ্য ভাব দ্বন্দ্ব। চরিত্র সেই দ্বন্দ্ব প্রকাশের উপকরণমাত্র। এখানে ঘটেছে ব্যক্তিচরিত্রের স্বাধীন বিবর্তন এবং ব্যক্তিচরিত্রের সর্বময় প্রতিষ্ঠা।


শেষের কবিতা উপন্যাসে অমূল্য ব্যক্তিত্ত্বের অন্তর্গূঢ় জীবন-স্পন্দনকে বাস্তবিক প্রতীতীর সীমায় ধরার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শোভনলাল-লাবণ্য-অমিত ও কেটীর মধ্য দিয়ে লেখক উগ্র ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য এবং সেই স্তরেই বুদ্ধিদীপ্ত কিংবা বুদ্ধিজীবী তরুণ-তরুণীর পারস্পরিক সম্পর্কের রহস্য সন্ধান করেছেন।


দুইবোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪) উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছেন পুরুষের উপর মাতৃজাতীয় ও প্রিয়াজাতীয় স্ত্রীলোকের প্রভাবের পার্থক্য কিরূপ হতে পারে। উপন্যাসদুটি নিতান্তই ছোট। এখানে জীবন কথার বিস্তৃর্ণ বনানী গড়ে ওঠেনি।


উগ্র এবং আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের তীব্র মোহ ও সর্বনাশী প্রলয় যে কিভাবে নরনারীর স্নিগ্ধ ও স্থির জ্যোতি প্রেম-প্রদীপকে নিভিয়ে দিতে পারে তারই মর্মন্তুদ কাহিনী নিয়ে রচিত ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)। এখানে রবীন্দ্রনাথ উগ্র স্বাদেশিকতার লোলুপ মূর্তিটি ফুটিয়ে তুলেছেন।


রবীন্দ্রনাথ আধুনিক বাংলা উপন্যাসের সর্বপ্রথম স্রষ্টা এবং আঁতের কথার যথার্থ রূপকার। তাই তাঁর নিজের এবং উপন্যাসের কতকগুলি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়-


১) রবীন্দ্রনাথ প্রথম বাংলা উপন্যাসকে বঙ্কিমী রোমান্সের পরিধি থেকে বের করে এনে তাকে বাস্তববাদী ও মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাসে পরিণত করে।


২) রবীন্দ্র উপন্যাসের চরিত্ররা বাইরের জগৎ ছেড়ে, নিজ অন্তর্লোকে আত্মমগ্ন হয়েছে বেশি।


৩) তাঁর উপন্যাসে সমাজ অনুমোদন ব্যতীতই প্রেমকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়।


৪) নারী প্রেম বিহীন পুরুষ যে অসম্পূর্ণ, অসার্থক, ব্যর্থ-এই তত্ত্ব তিনি তাঁর উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন।


৫) রবীন্দ্রনাথ কবি, তাই তাঁর ভাবময়তার আতিশয্য, অবাস্তব আদর্শ বিলাস তাঁর উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য।


৬) উগ্র স্বাদেশিকতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ উপনাসে স্থান পেয়েছে।


৭) যে অনুভূতিকে মুখে বোঝানো যায় না তাকে অন্তরে বিদ্ধ করার বাহন হিসাবে তিনি ভাষাকে ব্যবহার করেছে। তাই শ্রীবিলাস চরম আত্ম আবিষ্কার করেছে এইভাবে-


বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য গুরুত্ব পূর্ন প্রশ্ন ও উত্তর পেতে এখানে ক্লিক করুন


“আমি তো গৃহী হইতে পারিলাম না, আর সন্ন্যাসী হওয়া আমার ধাতে নাই, তাই আমার রক্ষা। তাই আমি যাকে কাছে পাইলাম সে গৃহী হইল না, সে মায়া হইল না, সে সত্য রহিল, সে শেষ পর্যন্ত দামিনী।”


রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলি আলোচনা করলে দেখতে পাই আমাদের জনবহুল পল্লীগ্রাম, দ্বন্দ্ববহুল সংসার ও পরিবার, দারিদ্র্য ও ঈর্ষা-বিদ্বেষের জীবনযাত্রা থেকে তার চরিত্ররা দূরবর্তী। তাছাড়া তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি যেন তাদের কৌলীন্য ত্যাগ করতে পারে না। তারা যেন আমাদের সাধারণ জীবনের সম সুখ-দুঃখ ভাগী প্রতিবেশী নয়। এই সমস্যার মূলে আছে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর অসাধারণ কবিপ্রতিভা। তাই উপদানের সঙ্গে অসাধারণ কবিপ্রতিভার পুনরায় সমন্বয় না হলে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত অনুবর্তী মিলবে না।