মনসামঙ্গলের কবি বিপ্রদাস পিপিলাই - কাব্যপরিচয়, কবিকৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা - pdf
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ সবচেয়ে জনপ্রিয় তম পর্ব হলো মঙ্গলকাব্য আর এই মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম বিষয় হলো মনসামঙ্গল। মনসামঙ্গলের জনপ্রিয় রচয়িতা দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এক কবি হলেন কবি বিপ্রদাস পিপিলাই । মনসামঙ্গলের অন্যান্য কবিদের মতো তার কাব্য টি ও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। আমরা এখানে কবি বিপ্রদাস পিপিলাই কাব্য পরিচয় ও কাব্য কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলাম।
![]() |
বিপ্রদাস পিপিলাই |
মনসামঙ্গলের কবি বিপ্রদাস পিপিলাই
উৎকৃষ্ট প্রতিভার অধিকারী না হলেও পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন মনসামঙ্গলের কবি হিসাবে বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের নাম স্মরণযোগ্য। কবির দেওয়া আত্মপরিচয় থেকে জানা যায়, তিনি বাদুড়্যা বটগ্রামে বাৎস্যগোত্রের পিপিলাই শাখার ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন। কবিরা চার ভাই। কবির পিতার নাম মুকুন্দ। কবি তাঁর কাব্যে কাব্যরচনার কাল নির্দেশ করেছেন এইভাবে –
সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ।
নৃপতি হুসেন শাহ গৌড়ের প্রধান।।
এই উক্তি অনুসারে কবির কাব্যরচনার কাল ১৪১৭ শক বা ১৪৯৫-৯৬ খ্রীষ্টাব্দ।
বিপ্রদাস তাঁর কাব্যকে ছয়বার ‘মনসাবিজয়’, নয় বার ‘মনসামঙ্গল’ এবং একবার ‘মনসাচরিত’ বলেছেন। কবি তাঁর গ্রন্থের প্রারম্ভে বর্ণিত বিষয়ের সংক্ষিপ্তসার দিয়েছেন। সাতটি পালায় তিনি তাঁর কাব্য সম্পূর্ণ করার সংকল্প নিলেও শেষপর্যন্ত দেখা যায়, নয়টি পালায় কাব্যটি রচিত হয়েও পুথি খণ্ডিত রয়েছে। চাঁদের বাণিজ্য-যাত্রা পর্যন্ত মাত্র কাহিনী বর্ণিত। কবি ব্রতকথা ও ব্যালাড এর অনুসরণে কাহিনী কল্পনা করেছিলেন বলে মনে হয়। কারণ এই দুই লোককথার বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্যে রয়েছে। তাছাড়া তিনি নিজের কাব্যকে ‘ব্রতগীর’ও বলেছেন।
পণ্ডিত-কবি বিপ্রদাস তাঁর কাব্যে বহু বিচিত্র কাহিনীর সঙ্গতিসাধন করেছেন। কাহিনীবয়নে ধারাবাহিকতা ও কাহিনী বর্ণনায় বাস্তবতা বজায় রেখেছেন কবি। বর্ণনাভঙ্গিও জীবন্ত। অন্যান্য কবিরা যেখানে বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেখানে বিপ্রদাস সমগ্র কাহিনীকে সুবিন্যস্ত করেছেন।
প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন
তবে তাঁর কাব্যে হাসান হোসেন পালাটি বৃহৎ ও বিচিত্র, অন্যান্য মনসামঙ্গলের তুলনায় সুপরিকল্পিত। তাঁর কাব্যে প্রাপ্ত মুসলমান সমাজ ও জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও তথ্যবহ পরিচয় একমাত্র মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল ছাড়া অন্যত্র দুর্লভ। মনসা-বিরোধের ফলে সর্পদংশনে বড় মিঞার মৃত্যু হলে বাড়ীর চাকর-নফরদের মনোভাব চমৎকার ফুটে উঠেছে –
মিঞা যবে ফৌত হইল গোলামের খোষ পাইল
বিবি লইয়া পলাইতে চায়।
মুসলমান সমাজের পরিচয় থাকলেও এই পংক্তি কৌতুকরসে উজ্জ্বল। লখিন্দরের বিবাহ রাত্রিতে চাঁদের বর্ণনাও হাস্যোদ্রেককারী –
চাঁদো রাজা নাচে কান্ধে হেতালের বাড়ি।
ঝলমল করে মুখে পাকা গোঁফ দাড়ি।।
করুণরসের প্রাবল্য তাঁর কাব্যে খুব বেশি না থাকলেও করুণ চিত্রের বর্ণনা আছে। লখিন্দরের মৃত্যুতে সনকার শোক এরকমই একটি দৃষ্টান্ত –
চির যে প্রাণের পুত্র দেও সম্বোধন।
পড়িল ধরণীতলে হরিয়া চেতন।।
বিপ্রদাসের কাব্যে মনসা চরিত্রের এক অভিনব বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয়। এই চরিত্র করুণা ও স্নেহমময়তা সঞ্চার বিপ্রদাসের অন্যতম প্রশংসনীয় কৃতিত্ব। হাসান যখন ভক্তির বশে দেবীর পূজা করেছেন তখন মনসার স্বরূপ চিত্রিত হয়েছে এভাবে –
হাসান এতেক যদি করিল স্তবন।
মনসা ব্যথিত অতি হইল তখন।।
অধিক বাড়িল দয়া আপন কিঙ্করে।
ডাকিয়া বলেন মাতা মধুর সুস্বরে।।
বেহুলা-মনসা-চাঁদের পারস্পরিক চরিত্র বর্ণনায়ও মনসাকে করুণাময়ী করে আঁকবার চেষ্টা লক্ষ করা যায়।
বিপ্রদাসের কাব্যে বেহুলার বেদনা, সনকার বিলাপ, চাঁদের দুর্গতি – এ সমস্তই সহজ-সরলভাবে বর্ণিত, সাহিত্যিক বক্রতা বা চারুত্ব নেই বললেই চলে। নরনারীর চরিত্রগুলিতে চারিত্রিক এমন কোন বৈশিষ্ট্য নেই যা অন্য মনসামঙ্গলকাব্যে লভ্য নয়। চাঁদের চরিত্রটিতে কবি সঙ্গতি রক্ষা করতে পারেননি। কাব্যশেষে সাড়ম্বরে মনসার পূজা করার মধ্যে চাঁদের দার্ঢ্য মলিন হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, মনসা-বিরোধিতায় অনুতপ্ত চাঁদ মনসার কাছে শাস্তি প্রার্থনা করেছে, চাঁদের উপর্যুপরি অনুরোধে দেবী চাঁদের মাথায় পদাঘাতও করেছ –
প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন
মনসামঙ্গলের অন্য কোন কবি চাঁদের এ হেন দুর্গতি ঘটাননি।
বিপ্রদাসের কাব্যে অলংকার আছে, কিন্তু তা অত্যন্ত সহজ। সংস্কৃত ছন্দও ব্যবহার করেছেন তিনি। কাব্যে নানাবিধ রাগ-রাগিনীর উল্লেখ রয়েছে। তাঁর কাব্যে কোথাও অশ্লীলতা বা গ্রাম্যতাদোষ নেই। কাব্য-কাহিনীটির ঘটনা বিস্তৃতি স্বচ্ছ, ধারাবাহিক্তা অক্ষুন্ন এবং বর্ণনাভঙ্গিমা উৎকট আতিশয্য-বর্জিত।
👉👉 বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করে থাকি আজ এখানে মনসামঙ্গলের জনপ্রিয় কবি বিপ্রদাস পিপিলাই সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছি ও তার কাব্য পরিচয় সম্পর্কে বর্ণনা করেছি। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্ন গুলি আমাদের এখানে আলোচনা করা আছে আপনার প্রয়োজন হলে নিচের দেওয়া লিংক গুলিকে ফলো করতে পারেন।
বিপ্রদাসের মঙ্গল কাব্যের ১৩টি খন্ডের না কি
উত্তরমুছুন