মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত (Bijay-Gupta) এবং তার কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা - pdf

   বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধারা মনসামঙ্গল কাব্যের উন্নত অদ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ কবি বিজয় গুপ্ত ( Bijay-Gupta )। মনসামঙ্গল কাব্য রচয়িতা হিসাবে তিনি বাঙ্গালীদের কাছে অধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। এখানে কবি বিজয় গুপ্ত ও তার কাব্য পরিচয় সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।


কবি বিজয়গুপ্ত

মনসামঙ্গলের কবিদের মধ্যে বিজয়গুপ্ত একটি পরিচিত নাম। একথা সত্যি যে বিজয়গুপ্তের জনপ্রিয়তা মনসামঙ্গলের অন্য অনেক কবির চেয়ে বেশি ছিল। বিশেষত পূর্ববঙ্গে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষনীয়। চৈতন্যপূর্ব কবিদের মধ্যে তাঁর একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। তবে জনপ্রিয়তার কারণেই তাঁর কাব্যে লিপিকর ও গায়েনদের প্রচুর হস্তক্ষেপও ঘটেছে।


কবিপরিচয়

বিজয় গুপ্তই প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে স্পষ্ট সাল-তারিখ উল্লেখ করা কবি। যদিও যে আত্মপরিচয় কবি দিয়েছেন তার প্রামাণিকতা নিয়ে যেমন সংশয় আছে তেমনই তার পাঠেও বিভিন্নতা দেখা যায়। নিজের কাল সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তার তিনটি ভিন্ন পাঠ রয়েছে। একটি পাঠে আছে-


ঋতুশশী বেদশশী পরিমিত শক।
সুলতান হুসেন শাহ নৃপতি তিলক।।


এই পাঠ অনুসারে ১৪১৬ শকাব্দ অর্থাৎ ১৪৯৪ খ্রীষ্টাব্দ এই সময়ে যেহেতু হুসেন শাহ গৌড়ে ছিলেন তাই মনে হয় এটিই কবির কাব্যরচনাকাল। বিজয় গুপ্তের জন্ম বরিশাল জেলার ফুল্লশ্রী গ্রামে। এই গ্রামে এখনো বিজয়গুপ্তের পূজিত মনসাদেবী রয়েছেন। তাঁর বাবার নাম সনাতন, মাতার নাম রুক্মিনী।


কাব্যপরিচয়

বিজয়গুপ্তের কাব্যের নাম পদ্মপুরাণ। মনসার আরেক নাম পদ্মা। তার থেকেই এই নামকরণ। তাঁর কাব্যে মূলত দুটি খণ্ড দেবখণ্ড ও নরখণ্ড। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী কবি কানাহরিদত্তের কাহিনীগত ত্রুটিগুলি সংশোধন করতে চেয়েছেন। যদিও তার কাব্যে লিপিকর ও গায়েনদের প্রচুর হস্তক্ষেপের নিদর্শন রয়েছে। তবুও স্থানীয় উপভাষা এবং পশ্চিমবঙ্গের সাধুভাষার অনুগামী ভঙ্গিমা একাব্যে স্পষ্ট।


কবিকৃতিত্ব

বিজয়গুপ্তের কাহিনীতে ঐক্য ও সংহতির অভাব রয়ছে। চৈতন্যপূর্ব বাংলার পাঠান রাজত্বের ঐতিহাসিক ও সামাজিক চিত্রে তাঁর কাব্য পরিপূর্ণ। কাব্যরচনার ক্ষেত্রে জীবনবোধের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না বলেই কাব্যের রূপচাক্‌চিক্য সৃষ্টির প্রতি তিনি বেশি করে ঝুঁকেছেন। পয়ার ও লাচারী ভিন্ন আধুনিক স্বরবৃত্ত ছন্দের আভাস বিজয়গুপ্ত দিয়ে গেছেন –


প্রেতের সনে শ্মশানে থাকে মাথায় ধরে নারী।
সবে বলে পাগল পাগল কত সইতে পারি।।
আগুন লাগুক কান্ধের ঝুলি ত্রিশূল লউক চড়ে।
গলার সাপ গরুড় খাউক যেমন ভাণ্ডাল মোরে।


প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন 

কোথাও আবার ভারতচন্দ্রের রচনার আভাসও পাওয়া যায় –


জগতমোহন শিবের নাচ।
সঙ্গে নাচে শিবের ভূত পিশাচ।।

কবির বিদগ্ধ বাচনভঙ্গী অনেকজায়গায় প্রবচনের মর্যাদাও পেয়েছে –


"সেই মুখে কণ্টক বইসে সেই মুখে খসে।"


অলংকার প্রয়োগেও কবির সতর্ক দৃষ্টি ছিল। এমনকি যে ব্যজস্তুতি অলংকার প্রয়োগ করে ভারতচন্দ্র অন্নদা-ঈশ্বরীর সংলাপকে চিরন্তনতা দান করেছেন তার প্রবর্তন প্রথম করেছেন বিজয় গুপ্ত তার মনসামঙ্গলে –


চণ্ডী বলে মোর দুঃখের নাহি ওর।
বৃদ্ধকালে স্বামী মোর পরনারী চোর।।


উপমা প্রয়োগেও কবির দক্ষতা লক্ষণীয়। চণ্ডীর কাছে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বর্ণনা করে মনসা বলেছেন –


শীতল ভাবিয়া যদি পাষাণ লই কোলে।
পাষাণ আগুন হয় মোর কর্মফলে।।


রসসৃষ্টির ক্ষেত্রে বিজয় গুপ্তের প্রতিভা খুব আকর্ষণীয় ছিল না। এই বিষয়ে কবিকে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়। মনসামঙ্গল সাধারণভাবে করুণরসের আকর হলেও বিজয়গুপ্তের হাতে এর কোন চমৎকৃতি লক্ষ্য করা যায় না। সংক্ষিপ্ত অবসরে কখনও কখনও করুণরসের প্রকাশ দেখা গেছে। লোহার বাসরঘরে লখীন্দরের মৃত্যুর পর মা সনকার অবস্থা বর্ণনায় এই রস উথলে উঠেছে –


কবাট করিয়া দূর বাসরে সামায়।
দেখিল সোনার তনু ধূলায় লুটায়।।
দুই হস্তে ধরি রাণী লখায় নিল কোলে।
চুম্বন করিল রাণী বদনকমলে।।


শৃঙ্গাররস সৃষ্টির ক্ষেত্রে কবি চাঁদ সদাগরের চরিত্রকে ব্যক্তিত্বশূন্য রূপে গড়ে তুলেছেন যা এই চরিত্রটির মধ্যে পূর্বাপর অবস্থার অসঙ্গতি সৃষ্টি করেছে। বাণিজ্য তরণী ডুবে গেলে নিদারুণ কষ্টের মধ্যেও চারপণ কড়ি নিয়ে চাঁদ সদাগর বলেছেন –


একপণ কড়ি দিয়া ক্ষৌরশুদ্ধি হব।
আর একপণ কড়ি দিয়া চিঁড়া কলা খাব।।
আর একপণ কড়ি নিয়া নটি বাড়ি যাব।
আর একপণ কড়ি নিয়া সনকারে দিব।।


হাস্যরস সৃষ্টিতেও বিজয়গুপ্তের রুচিকে আঘাত করেছে। রাখালদের মনসাপূজা করতে দেখে হাসান-হুসানের সহকারী খোনকার ঘর ভাঙতে গেলে রাখাল বালকরা তাকে বিছুটি বনে নিয়ে গিয়ে বলে –


খোনকার রেগে গিয়ে সেই গাছকে অসম্মান করতে যান এবং তখন তিনি কীভাবে জব্দ হন তার বর্ণনা ধূলিলুন্ঠিত হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।


রসসৃষ্টির ক্ষেত্রে কবির দূর্বলতাকে বাদ দিলে চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিজয়গুপ্তের দক্ষতা সব ক্ষেত্রে অস্বীকার করা যায় না। তাঁর দেবতা চরিত্রগুলি দেবত্বের চিহ্ন বর্জিত সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতির বিশিষ্ট সৃষ্টি।

মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্ত (Bijay-Gupta)
Educostudy.in/Bijay-Gupta


 বাংলার ধূলিমলিন যে গৃহাঙ্গনে একাব্যের জন্ম সেখানে শিব-চণ্ডী-মনসা কেউই কোন ভাবে বিশুদ্ধ দৈব প্রকৃতি রক্ষা করতে পারেন না তা কবি জানতেন। একটি মাত্র স্থানে মনসা চরিত্র তাই যথাযথ বিকাশলাভ করেছে। জরৎকারু ঋষি মনসাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এ পরিস্থিতিতে মনসার উক্তি বেদনাবহ –


জনমদুখিনী আমি দুখে গেল কাল।
যেই ডাল ধরি আমি ভাঙে সেই ডাল।।


তবে মানব চরিত্রগুলির বর্ণনায় কবি অনেক সচেতন ছিলেন। বিশেষত বেহুলা ও সনকার চরিত্র নিঃসন্দেহে চমৎকার। লখীন্দরকে সর্প দংশনের পর বেহুলার বিলাপ নিঃসন্দেহে তার চরিত্রে অসামান্য মাত্রা যোজনা করেছে –


আম ফলে থোকা থোকা নুইয়া পড়ে ডাল।
নারী হইয়া এই যৌবন রাখিব কতকাল।।
সোনা নহে রূপা নহে অঞ্চলে বাঁধিব।
হারাইলাম প্রাণপতি কোথা যাইয়া পাব।।


পুত্র হারিয়ে চাঁদের গম্ভীর বিলাপ এবং সনকাকে সান্ত্বনা দানও উল্লেখযোগ্য –


শীতল চন্দন যেন আভের ছায়া।
কার জন্য কান্দ প্রিয়া সকল মিছা মায়া।।


বৈরাগ্যের এই বিষাদ অতলস্পর্শী শোক সৃষ্টি করে সান্ত্বনাকে হার মানায়। কে বলতে পারে একালের কবি মধুসূদন মন্দোদরীকে রাবণের সান্ত্বনা দানের চিত্র আঁকতে গিয়ে এই পূর্ববর্তী কবির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কিনা? চাঁদ সদাগর পৌরুষে ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে অপূর্ব গৌরব লাভ করেছে। সম্পদ, সংসার কোন কিছুর ধ্বংসে তিনি বিচলিত হননি। তার পাশে মনসা অতি নীচ, শ্রীহীন। তবুও চাঁদ বিজয়গুপ্তের কাব্যে কামাতুর। তাই অনেক ক্ষেত্রে অসঙ্গত। এমনকি বেহুলা লখীন্দর স্বর্গে নিরুদিষ্ট হওয়ার পরে বিজয়গুপ্ত লিখছেন –


পুত্রবধূ শোকে চান্দ দুঃখভাবে মন।
জোড় হাতে মনসার করয়ে স্তবন।।
তোমার প্রসাদে আমি ভুঞ্জিলাম সুখ।
পুত্রবধূ শোকে মোর বিদরিছে বুক।।


চাঁদ সদাগরের আকাশ-ছোঁয়া পৌরুষ এখানে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। বাণিজ্যে গিয়ে মনসার চক্রান্তে চাঁদের দুর্দশার বর্ণনায় মনসার মহিমা বৃদ্ধি হয়নি চাঁদের চরিত্র অকারণে কলঙ্কিত হয়ে গেছে। সকলের অনুরোধেও চাঁদ মনসাপূজা করতে চাননি –


ধনে জনে কার্য নাহি যাহুক আরবার।
পদ্মা না পূজিব আমি কহিলাম সার।।


অবশেষে চণ্ডীর কৃপায় চাঁদ বুঝেছেন চণ্ডী ও মনসার মধ্যে বিভেদ নেই –


এমন মূরতি আমি কভু দেখি নাই।
এতকাল মোরে কেন না বলিলে আই।।
যেই মুখে বলিয়াছি লঘু জাতি কানি।
সেই মুখে ভস্ম দেও জগতজননী।।


এই বর্ণনাই মনসা ভক্তির জয় হয়েছে, চাঁদের চরিত্রের চূড়ান্ত পরাজয়। দেবীর মহিমা প্রচার করতে গিয়ে কবি কাব্য মহিমাকে পদদলিত করেছেন। এদিক থেকে নারায়ণদেব অনেক বেশি উচ্চে। আসলে বিজয়গুপ্তের কাল নিঃসন্দেহে বাঙালীর জনজীবনের এক পরিবর্তমান যুগ, এক নবনির্মিতির সন্ধিক্ষণ।


 দেব মহিমা না মানব মহিমা কাকে সমাজ নেবে, কাকেই বা ত্যাগ করবে তা তখনও নিঃসংশয়ে স্থির হয়নি। কাহিনীগত ঐক্য সংরক্ষণ তাই সেই অশিক্ষিত পটু শিথিল সমাজ ব্যবস্থার কবি হিসাবে বিজয়গুপ্তের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু কবির জীবন অভিজ্ঞতা বাস্তব পর্যবেক্ষণ শক্তি কল্পনার সীমাবদ্ধতাকে কিছুটা আড়াল করতে পেরেছে। একারণেই মনসামঙ্গল কবিদের মধ্যে অসামান্য প্রতিভাধর না হলেও কবি স্মরণীয় বটে।



👉👉  আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করে চলেছি। এ পর্যন্ত যে সকল প্রশ্ন গুলি বাংলা সাহিত্য থেকে আমরা আলোচনা করেছি তার সমস্ত প্রশ্নের লিংক উপরে দেওয়া আছে। অবশ্যই আমাদের ফেসবুক পেজ ফলো করে রাখতে পারেন।