বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে ‘প্রার্থনা’ কি ? বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে প্রার্থনা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি - pdf
বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রার্থনা পর্যায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং এই অধ্যায়ে থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী লেভেল এ প্রশ্ন হয়ে থাকে।বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রার্থনা পর্যায় শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে এখানে আমরা আলোচনা করলাম।
বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে ‘প্রার্থনা’ কি ?
বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে ‘প্রার্থনা’ হল ব্যক্তি চরিত্রের স্বরূপ নির্ণয়ের প্রয়াস। এগুলি আত্মকথনমূলক পদ। ‘প্রার্থনা’ শীর্ষক পর্যায় নানা দিক থেকে একটি উল্লেখযোগ্য বিশিষ্ট রসপর্যায়। প্রধানত ভক্তিরস এই পর্যায়ের মূল বৈশিষ্ট্য। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় রসশাস্ত্র অনুযায়ী পঞ্চরসের তত্ত্ব স্বীকার করলেও বাস্তবে তাঁদের ‘দাস্যভাব’ এর প্রতি অনীহা দেখা যায়। দাসভাবে ভগবানকে প্রভুরূপে উপাসনা করা হয়, অতএব এই ভাবের উপাসনায় ভগবানের ঐশ্বর্য রূপই প্রকটিত হয়।
![]() |
Educostudy.in/প্রার্থনা |
কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ মূলত মধুর রসের সাধক বলেই তাঁরা ভগবানের ঐশ্বর্যভাবকে কখনো কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে ভক্ত একান্ত নিষ্ঠায় তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করে থাকেন এবং মুক্তির কামনা প্রকাশ করেন। ভক্ত এবং ভগবানের মধ্যে এরূপ অবস্থার মধ্যেই শান্তরসের সৃষ্টি হয়। এই শান্তরসাশ্রিত পদে তখন ভক্ত কবি এই অসার অনিত্য সংসার থেকে উদ্ধার পাবার জন্য ঐকান্তিকভাবে প্রার্থনা জানান, তখন তাকেই ‘প্রার্থনার পদ’ বলা হয়। ‘প্রার্থনা’র পদগুলোতে ভক্তের আত্মসমর্পন ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়।
প্রার্থনা বিষয়ক পদে ভক্তের যে অনুতাপ প্রকাশ পেয়েছে তাতে প্রধানত তিনটি জিনিসের প্রধান্য দেখা যায়। প্রথম জীবনের কাঞ্চনসক্তি, কামাসক্তি এবং শেষজীবনের নিঃসঙ্গত্ব। এখানে কবির চরিত্রগত দুর্বলতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনই প্রকাশ পেয়েছে পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে মুক্ত হতাশা। তাই ভক্ত জীবনের শেষ দেহলীতে দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে ভগবানের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাদের ভক্তরসের অসামান্য স্ফূরণ প্রকাশ পেয়েছে।
ভাগবতে বলা হয়েছে ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্’ – এই যে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, তিনিই প্রার্থনা পদের কেন্দ্রীয় চরিত্র। কবিরা ভক্তরূপে সাধক রূপে তাঁর চরণতলে বসে তাঁর কৃপা প্রার্থনা করেছেন। বৈষ্ণব কবিগণ তাঁদের ভক্তির খেয়া নৌকাটির সাহায্যে বাধাসংকুল দুস্তর পথ অতিক্রম করে সরাসরি ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়েছেন। কবিরা ভক্তি বিনম্রভাবে আত্মসমর্পন করে ঈশ্বরের পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়েছেন।
বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে প্রার্থনা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি
রে প্রমত্ত মম মম কবে পোহাইব রাতি
জাগিবি রে কবে।
জীবন উদ্যানে তোর যৌবন কুসুম ভাতি
কতদিন রবে?
বিদ্যাপতিরও এই সুর আত্মসম্বিতের আচম্বিত জাগরণ। বিদ্যাপতি ভোগী কবি কিন্তু ভোগবদ্ধ কবি নন। অর্জনে বিশাল বলেই বর্জনে গম্ভীর এই কবির জীবন। প্রার্থনা পদে বর্জনের গৌরবে তিনি মহীয়ান। এখানে আছে আত্মদর্শনের মহিমা। অসীম শূন্যতাবোধে যে কাব্য গৌরবান্বিত, জীবনকে নিঃশেষে পান করবার পরেও রসশূন্য তৃষ্ণার্ত জিহ্বার আর্তনাদ সেখানে শোনা যায়।
বিদ্যাপতি প্রমত্ত বাসনায় জীবনের কণ্ঠালিঙ্গন করলেন, কিন্তু চমকে দেখলেন আলিঙ্গনে ধরে আছেন সুঠাম দেহের পরিবর্তে শীর্ণ গহ্বরময় কঙ্কাল; সেই কঙ্কালকে ছুঁড়ে ফেলে নৈরাশ্যে ভয়ে তিনি কেঁদে উঠলেন। প্রার্থনার পদে সেই ক্রন্দনমোচন; দেহশ্মশানে দেহজীবন প্রেমীর বিলাপ সঙ্গীত। তাই কবি বললেন –‘তোহে জনমি পুনঃ তোহে সমায়ত সাগর লহরী সমানা।’ কবি প্রার্থনা জানিয়েছেন –
সেই প্রার্থনা আরো গভীর বিশ্বাসে উদ্ভাসিত হয়েছে যখন তিনি বলেন –
আদি অনাদিনাথ কহায়সি।
অবতারণ ভাব তোহারা।।
বলাবাহুল্য বিদ্যাপতির প্রার্থনা বিষয়ক পদে কবির হৃদয়ার্তি অকপট। তাঁর ব্যক্তিগত আবেদন সর্বজনীন মূর্ছনায় পরিব্যপ্ত কবির গভীর আত্মনিবেদনের স্বতোৎসারিত হৃদয়ার্তি চিরকালের মানব হৃদয় জয় করেছে। ভক্ত হৃদয় তো বটেই, সাধারণ পাঠকও কবির হৃদয়ার্তির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেন বলে ওঠে –
তাতল সৈকতে বারি বিন্দু সম
সুতমিত রমনী সমাজে।
তোহে বিসরি মন তোহে সমর্পিলুঁ
অব মঝু হব কোন কাজে।।
মাধব হাম পরিণাম নিরাশা।
বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রার্থনা পর্যায় ও প্রার্থনা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। যদি এই আলোচনা আপনার সাহায্য করে থাকে তবে অবশ্যই নিচের কমেন্ট করবেন।এছাড়াওপ্রয়োজনে এখান থেকে আপনি তা দেখে নিতে পারেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন