বৈষ্ণব পদাবলীতে নিবেদন কি ও নিবেদন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করো - pdf

    বৈষ্ণব পদাবলীতে নিবেদন পর্যায় এবং নিবেদন পর্যায়ের সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হলো। বৈষ্ণব পদাবলী তে নিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। যেখানে রাধার আত্মার নিবেদন কৃষ্ণ তে সর্বস্ব দানে পুষ্পাঞ্জলি ধারণ করেছে। এই পোস্ট টিতে বৈষ্ণব পদাবলীতে নিবেদন পর্যায় এবং নিবেদন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। 


বৈষ্ণব পদাবলীতে নিবেদন কি


বৈষ্ণব পদাবলীতে নিবেদন মধুর রসপর্যায়েরই একটি স্তর বিশেষ। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে নিবেদন কোন পৃথক পর্যায় হিসাবে চিহ্নিত নয়। অনুরাগ পর্যায়ের একটি স্বতন্ত্র স্তর হিসাবে এটি পৃথক মর্যাদা পেয়েছে। আক্ষেপানুরাগে যে বিচ্ছেদের সুর মিলনের মধ্যেও বাজতে থাকে নিবেদনে তা দূরে চলে গিয়ে এক পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন প্রকাশিত হয়।


   পুর্বরাগে হৃদয়মথিত বেদনার সুর, মিলনের আনন্দেও প্রেমবৈচিত্ত্যের সশঙ্ক বেদনা, আক্ষেপানুরাগে সমাজ-পরিবার-প্রেমের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত সত্তার আর্ত হাহাকার, বিরহ পর্যায়েও সেই অনির্বান বেদনাধারার অবিরল প্রবাহ শেষপর্যন্ত নিবেদনের পদে রাধার অশ্রুস্রোতস্বিনী রূপে কৃষ্ণ সমুদ্রের মাঝখানে বিলীন হয়ে যায়।


  এই সমর্পনেই রাধার শান্তি, রাধার বিশ্রাম, রাধার দ্বিধা-বিভক্ত সত্তার যন্ত্রনার পরিসমাপ্তি তাই ‘নিবেদন’ পর্যায়ে রাধার সর্বস্ব সমর্পনের নম্র-প্রণাম লক্ষণীয়। এখানে রাধার পরিপূর্ণ সমর্পনের সুর যেন স্নিগ্ধ চন্দন-বাসিত। এই ‘নিবেদন’ পর্যায়েই কৃষ্ণের প্রতি রাধার অপার্থিব অনিকেত আত্মনিবেদন পাঠককেও অশ্রুধারায় সিঞ্চিত করে।


নিবেদন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি

‘নিবেদন’ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাসের জীবনের রূপই পৃথক। চিন্ময় সূর্যকে তিনি প্রভাতেই দেখেছেন। সেই সূর্যকে তৎক্ষণাৎ মেনে মৃত্তিকায় সূর্যবরণের সাধনায় মেতেছেন। দ্বিধা, সন্দেহ তার ছিল না, শুধু ছিল বরণ আর নিবেদন। চণ্ডীদাস এবং তাঁর রাধিকা বেদনার গান গেয়ে সূর্যসত্যকে বন্দনা করে গিয়েছেন। বিদ্যাপতির প্রার্থনা যেখানে তার নিজের প্রার্থনা, চণ্ডীদাসের ‘নিবেদন’ সেখানে নিজের নয়, তাঁর রাধিকার।

বৈষ্ণব পদাবলীতে নিবেদন কি ও নিবেদন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করো।
Educostudy.in/নিবেদন 


   বিদ্যাপতি ও বিদ্যাপতির রাধা এক নন, তাই কবির প্রার্থনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চণ্ডীদাস ও চণ্ডীদাসের রাধিকা বহু সময়ই একাত্ম, রাধার নিবেদন তাই চণ্ডীদাসেরও নিবেদন। তাই চণ্ডীদাসের আত্মনিবেদন ‘ভক্তিস্তোত্র’। বিদ্যাপতির প্রার্থনা সেখানে সাধনা সঙ্গীত। দেবতার মন্দিরের দ্বার কবির করস্পর্শে নয়, সেখানে প্রাণস্পর্শে মুক্ত হয়, কবির কাব্য সেখানে স্তোত্রে উন্নীত। চণ্ডীদাসের রাধা পরিপূর্ণ আত্মসমর্পন করে বলেছেন -


বঁধু তুমি সে আমার প্রাণ
দেহ মন আদি 		তোহারে সঁপেছি
কুল শীল জাতি মান।।

দেহ-মন-প্রাণ সবকিছুই রাধা আজ সঁপে দিয়েছে কৃষ্ণের পায়ে। রাধা কৃষ্ণের ঐশ্বর্য জানে। রাধা জানে এই কৃষ্ণই নিখিল ভুবন নাথ, রাধা জানে এই কৃষ্ণই যুগ-যুগান্তরের যোগীর আরাধ্য ধন। রাধা এও জানে কৃষ্ণকে পাওয়ার মত তপস্যার সঞ্চয় তার নেই। সে শুধু দুঃখ ভোগের মহামূল্যে দুঃখজয়ী পুরুষোত্তমকে নিজের করে নিতে চায়। তার সমস্ত কলঙ্কে, তার সমস্ত পাপ-পূণ্য, বেদনা কৃষ্ণকে পাওয়ার মধ্যেই শাশ্বত সার্থকতা লাভ করে।


    প্রেমরসে শরীর মনকে সিক্ত করে শুধু কৃষ্ণের কাছে সে সঁপে দিতে পারে। কৃষ্ণই তার স্বামী, কৃষ্ণই তার অনন্য আশ্রয়। সমাজ সংসারের অন্য কোন ছবিই তার চোখে ধরে না। রাধা জানে কৃষ্ণ প্রেমের প্রেরণায় যে সমাজকে তিনি অস্বীকার করেছেন সে সমাজ তাকে এই কারণেই কলঙ্কী বলে আখ্যাত করেছে, অসতী বলে নিন্দা করেছে, একজন নারীর ললাটে এই কলঙ্ক লেপন চরম অসম্মানের, যন্ত্রণার হতে পারত। কিন্তু কৃষ্ণ যে তার প্রাণনাথ এই ভাবনায় সে সবকিছু উপেক্ষা করতে পেরেছে এবং তদগতচিত্তে আত্মসমর্পনের সুরে বলেছে –

 

কলঙ্কী বলিয়া 	ডাকে সব লোকে
তাহাতে নাহিক দুখ।
তোমার লাগিয়া 	কলঙ্কের হার
গলায় পরিতে সুখ।।

চণ্ডীদাস তাঁর স্বাভাবিক সরল কাব্যভাষায় অনন্ত কালের এই পরিপূর্ণ –আত্মনিবেদনের বিনম্র প্রণতিটুকু প্রেমের দীপারতিতে উজ্জ্বল করে দেখিয়েছেন। যে কৃষ্ণ ঐশ্বর্যভাব মণ্ডিত সে কৃষ্ণ আসলে শ্রীরাধার কাছে পরম প্রিয় প্রাণনাথ। তাকে ছাড়া রাধার জীবন বৃথা।


প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন 

 তার চরণে নিঃশেষে আত্মনিবেদনে রাধার জীবনের সার্থকতা। আর ঐ আত্মনিবেদনের মধুর অতিময় বাণীটুকু রচনা করে কবিও যেন তার সাথী অথবা নিত্যকালের আত্মনিবেদনকামী প্রেমপিপাসু ভক্ত সাধকের অন্তরের বাণী নির্মাতা।


     নিবেদন পর্যায়ে চণ্ডীদাসের ভক্তি বিক্ষোভশূন্য শান্তির স্নিগ্ধতা পরিপূর্ণ মাত্রায় লাভ করেছে। এজন্য চণ্ডীদাসকে কোনও তত্ত্বের দারস্থ হতে হয়নি। তাঁর আপন কবিপ্রানের প্রেরণাই তাকে এই ধরণের পদ রচনায় উৎসাহিত করেছে। তাই চণ্ডীদাস বিশুদ্ধ লৌকিক প্রেমের কবি হয়েও শান্ত রসাশ্রিত ভক্তির সর্বোৎকৃষ্ট রূপকার।


👉👉  এখানে বৈষ্ণব পদাবলী তে নিবেদন নিবেদন পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যদি ভালো লাগে তবে নিচে কমেন্ট করবেন। আরও বৈষ্ণব পদাবলী ও বাংলা সাহিত্যের প্রশ্ন গুলির জন্য নিচের প্রশ্ন গুলি দেখতে পারেন।