মেঘনাদবধ কাব্যের নায়ক চরিত্র ইন্দ্রজিৎ তথা মেঘনাথ সম্পর্কে আলোচনা - pdf

   মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত আধুনিক যুগের সাহিত্যিক মহাকাব্য হল মেঘনাদবধমেঘনাদবধ কাব্যটি কবি মধুসূদন দত্ত বীর রসে রচনা করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তিনি করুন রসে পর্যবসিত করেছেন। কাব্যটির আদ্যপ্রান্ত জুড়ে আছে মধু কবির প্রাণের সন্তান মেঘনাদের বীর চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ আর মৃত্যুর আত্ম ক্রন্দন। মধুসূদন দত্তের সৃষ্টি এই মেঘনাথ চরিত্রটির সম্পর্কে আমরা আজ এখানে আলোচনা করব। 


মেঘনাদবধ কাব্যের নায়ক চরিত্র ইন্দ্রজিৎ সম্পর্কে আলোচনা ।


    মাইকেল মধুসূদন দত্তের এক অনন্য সাধারণ সৃষ্টি এই মেঘনাদবধ কাব্যটি। তার শিল্প আত্মার প্রধান লক্ষণ  ভাবুকতার প্রধান সংযম ও বীরধর্মী সৌন্দর্য সৃষ্টি। কাব্যটির নাম যেহেতু মেঘনাদ বধ অর্থাৎ ইন্দ্রজিতের হত্যা, সে কারণে সাধারণ পাঠক খুব সহজেই মেঘনাথ চরিত্রটিকে বারবার গ্রহণ করতে চেয়েছে। অনেক সমালোচকের মতে এ কাব্যের নায়ক রাবণ। কারণ এই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে কবির আত্মার প্রতিফলন ঘটেছে। তবুও মাইকেল মধুসূদন দত্তের চিঠিগুলোর অনুসারে ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ যেয়ে কাব্যের নায়ক সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে না। 


    বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী সত্তা নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মেঘ্নাদবদ কাব্য কে রচনা করেছিলেন। কাব্য টি তে নটি খন্ড যার ষষ্ঠ খন্ডের নাম বধ । আসলে কাব্যের মূল ঘটনাটি এই স্বর্গ টিতেই ঘটেছে বলে সমস্ত কাব্যের মধ্যে এই স্বর্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই স্বর্গ টিতে ইন্দ্রজিতের বীরচিত সত্তা প্রকাশিত হয়েছে। রাবণ পুত্র ইন্দ্রজিৎ মাইকেল মধুসূদন দত্তের অন্তর্জাত  সন্তান । তিনি খুব সহজেই দেবতা, দৈত্য দের পরাজিত করতে সক্ষম। 


    কনক লঙ্কার বিপর্যয়ের সময় একমাত্র ইন্দ্রজিৎ ভরসা। তাকে কেন্দ্র করে রাবণের সমস্ত যুদ্ধযাত্রার পরিকল্পনা। যদিও কবি বারবার এই পটভূমি তৈরি করতে গিয়ে নিজের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছেন। তিনি কখনো চান নি যে তার মানস পুত্রের এমন শোচনীয় ভাবে মৃত্যু হোক। তাই তিনি বন্ধু রাজনারায়ণ বসু কে লিখেছিলেন - "It costs me many a tear to kill him" । আবার এই ষষ্ঠ সর্গে ইন্দ্রজিতের দেশপ্রেম স্বজনপ্রীতি এবং বীর মহিমার প্রকাশ ঘটেছে। 


   পিতৃব্য বিভীষণ গোপন পথে যজ্ঞাগারে লক্ষণ কে নিয়ে এসেছেন মেঘনাদ কে হত্যা করার জন্য। এই ঘটনা জেনে ইন্দ্রজিৎ তার পিতৃব্য কে বারবার ধিক্কার জানিয়েছেন। আবার লক্ষণের অতর্কিত আক্রমণ এবং হীন কর্মপ্রয়াস ইন্দ্রজিতের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ঘৃণ্য ঘটনা। সমুন্নত বংশ মর্যাদা বোধ চরিত্রে আরেক লক্ষণীয় দিক। তিনি লঙ্কার রাক্ষস বংশকে তুলনা করেছেন শিবের ললাটের সঙ্গে। বিভিন্ন উপমা ব্যবহার করে তার বিপথগামী কাকাকে বারবার রাবণের পক্ষে ফেরানোর চেষ্টা করেছেন। তার কাছে চিরন্তন ধর্মবোধের চেয়ে জ্ঞাতিত্ব ভ্রাতৃত্ব ও জাতীয়তাবাদ মহৎ। 


   ইন্দ্রজিৎ তাই দেশ জাতি কুল মান এর গর্ভে উদ্ধত উচ্চ শিখর । আবার তিনি উন্নত সমর নীতি বোধের ও অত্যন্ত অভ্রান্ত এক প্রতীক। পূজারত প্রতিপক্ষকে অস্ত্র গ্রহণের সুযোগ না দিয়ে অতর্কিত আক্রমন তার বিচারে কোন বীর কর্ম নয় তা কলঙ্কময় নিচু জাতি কর্ম। ইন্দ্রজিৎ শুধু বীর নন তিনি একনিষ্ঠ পিতৃ-মাতৃ ভক্ত। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে তিনি পিতা-মাতার পাদপদ্ম স্মরণ করেছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সত্য ও ন্যায়ের অভ্রান্ত প্রতীক এই বীর মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করেছেন। মৃত্যু হয়ে তার কোনো ভয় নেই তাই বলেছেন - " রাবণ নন্দন আমি, না ডরি শমণে" । 


   বীর মেঘনাদের বুদ্ধি চাতুরতা যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে কাব্যে তাতে কবি ও মানসপুত্র মেঘনাদের বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পিতৃব্য বিভীষণকে সুপথে আনতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ। 


    লক্ষণ তাকে বাণে বিদ্ধ করলে রক্তাক্ত অবস্থায় হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই দিয়ে সে লক্ষণকে আঘাত হানে। কিন্তু মায়াদেবীর ছলনায় তার কোনো কিছুই লক্ষণের শরীরকে স্পর্শ করতে পারে না। এরপর লক্ষণ তাকে তরবারি দ্বারা ভূপতিত করে দেয়। কিন্তু এই পর্বে কবি যেমন নিজে কেঁদেছেন তেমনি বর্ষার মতো রক্তের ধারায় রাবণ সহ সমস্ত পাঠক কে কাদিয়েছেন। তাই আমরা যেভাবেই মেঘনাথ চরিত্রটিকে বিশ্লেষণ করি না কেন সে আমাদের কাছে চির এক বীর। 


প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন 

    আবার তার বীর ধর্ম কে এক সামান্য নরের হতে শেষ হতে দিতে চান না। তাকে শত্রুর কাছে মরতে হবে বলে কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু তার আক্ষেপ এক সামান্য নরের হাতে লক্ষণের মত ভীরু কাপুরুষের হাতে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে এতে তার আক্ষেপের সীমা নেই। ইন্দ্র বিজয়ী বীরের এমন মৃত্যু পাঠকের মনে ইচ্ছা ছিল না। কারণ দেবতাদের বলে শক্তিশালী হয়ে কৌশল অবলম্বন করে অতর্কিতভাবে লক্ষণ তাকে হত্যা করেছে। হয়তো লক্ষণ এর কাছে পরাজিত হয়েছে নিহত হয়েছে কিন্তু কাব্যের ষষ্ঠ সর্গে মেঘনাদের চরিত্রের ধর্ম গুলি প্রকাশিত হয়েছে তা অন্য সকল কাব্য থেকে মেঘনাথ কাব্যটিকে অনন্য করে তুলেছে।