শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বিভিন্ন চরিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আলোচনা - pdf

    বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। 1909 সালে বাঁকুড়া জেলার কাকিলা গ্রাম থেকে এই প্রতিটি আবিষ্কার হয় 1916 সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি মোট তিনটি চরিত্র নিয়ে কাহিনী পরম্পরায় গড়ে উঠেছে যার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমলীলা। 

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বিভিন্ন চরিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আলোচনা
Educostudy.in/শ্রীকৃষ্ণকীর্তন


    শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য থেকে যে সকল প্রশ্ন গুলি গুরুত্বপূর্ণ এবং পরীক্ষায় আসার মত সেই সকল প্রশ্ন গুলি নিয়ে এখানে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হলো যা উত্তরগুলি 6 থেকে 10 নম্বরের মত করে লেখা হলো প্রয়োজন অনুসারে প্রশ্ন-উত্তর ছোট বড় করে লেখা যেতে পারে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য থেকে যে সকল প্রশ্ন গুলি আলোচনা করা হল সেগুলি হল - 


  1. বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
  2. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাব্য বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
  3. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বিষয়েও আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দাও।


বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো


   বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা অবলম্বন করে লেখা একটি আখ্যান কাব্য। এর বিন্যাসে আছে নাটকীয়তা অন্তরে গীতি ধর্মের লক্ষণ। সমগ্র কাব্য টি 13 টি খন্ডে বিভক্ত - জন্মখন্ড, তাম্বুলখন্ড, দানখন্ড, নৌকাখন্ড, ভারখন্ড, ছাত্রখন্ড, বৃন্দাবনখন্ড, কালিয়দমন খণ্ড, যমুনাখন্ড, হারখন্ড, বান খন্ড, বংশীখণ্ড এবং রাধা বিরহ। 

    শেষ খন্ড টির নাম রাধা বিরহ এখানে কোন খন্ড উল্লেখ না থাকায় অনেকে এটিকে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করেন। এ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে জলঘোলা রেষারেষি আজও লেগে আছে। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম থেকে মথুরা পর্যন্ত গমনের বিভিন্ন কাহিনী এই সকল খন্ড গুলিতে বর্ণিত হয়েছে। মানুষের মঙ্গল সাধন ও কংস বধ এর জন্যবিষ্ণু ও লক্ষী দেবীর যথাক্রমে কৃষ্ণ ও রাধার রূপে আবির্ভাব ঘটে।

    কৃষ্ণ সম্পর্কে আয়ান ঘোষের ইস্ত্রি রাধার প্রথমে বিরূপ মনোভাব থাকলেও বড়াই এর মধ্যস্থতায় তা দূর হয়। কংস বধ এর জন্য কৃষ্ণ বলে রাধা তার বিরহে কাতর হয়ে পড়েন। সংস্কৃত ভাষায় পন্ডিত কবি বড়ু চন্ডীদাস ভাগবত পুরাণ এবং জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে এ কাব্যের রসদ গ্রহণ করেছিলেন। আবার তিনি লোকজীবন নির্ভর যে কাহিনী তাও গ্রহণ করেছিলেন।

    চরিত্র-চিত্রন ও কাহিনী বর্ণনায় পৌরাণিক তা থেকে মর্ত্য জীবনের বৈশিষ্ট্য বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন এর চরিত্রগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছে। রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই এই তিনটি চরিত্রের উক্তির মধ্য দিয়ে কাহিনীর যেমন অগ্রগতি ঘটেছে তেমনি বিকশিত হয়ে উঠেছে চরিত্রগুলি। 

   শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে পয়ার ত্রিপদী ছন্দের প্রয়োগ ত্রুটিহীন ভাবে না লেখা হলেও এখানে কবির দক্ষতার পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। অলংকার শাস্ত্রের অনুসরণে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক অলংকার প্রয়োগের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় এই কাব্যে। সামগ্রিকভাবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য শুধুমাত্র আদি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন নয় সাহিত্যে মূল্যের দিক থেকেও এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। 


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কাব্য বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।


   চর্যাপদে বাংলা সাহিত্যের যে পথ চলা শুরু হয়েছিল তার পরবর্তী ধাপ ছিল আদি মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি চর্যাপদ এর থেকে অনেক জ্বর মুক্ত ও পরিণত বলে ভাষাবিদগন মনে করেন। এ কাব্যের জটিলতা তিনটি চরিত্রের আবর্ত নিয়ে রচিত হয়েছে। আধুনিক যুগে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি আবিষ্কারক সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের প্রাথমিক ভীত যে আরো সুগঠিত হয়ে উঠলো তাতে কোনো দ্বিধা রইল না। 

    শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য এবং চর্যাপদ কাব্য কবিতার আদি যুগের রচনা হলেও দুয়ের মধ্যে কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। এই সকল বৈশিষ্ট্যের জন্য চর্যাপদ এর থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বৈশিষ্ট্য কত দিকের ফারাক দেখা যায়। যেমন চর্যাপদের মোট 50 টি পদ রচিত হয়েছিল কিন্তু বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পদের এর আধিক্য নয়, 11 টি খন্ডের প্রথম পর্বের আবির্ভাব ঘটল। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' এ যে সকল কাব্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় সেগুলি হল - 

  1. তেরো টি খন্ডের রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বাংলা সাহিত্যে রাধা কৃষ্ণ কথার প্রথম লৌকিক আখ্যান কাব্য। জন্ম খন্ড দেবতাদের প্রার্থনায় বিশ্বকে ভারমুক্ত করতে রাধা কৃষ্ণের আবির্ভাব দিয়ে এই কাব্যের শুরু আর কংস বধের জন্য কৃষ্ণের মথুরা গমন, আক্ষেপ, যন্ত্রণা দিয়ে আখ্যানকাব্য টির সমাপ্তি ঘোষণা হয়েছে।
  2. গীতিনাট্য বিবৃতির মিশেলে রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের শেষে রাধার হৃদয়ের আর্তিতে গীতিময়তা, "কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি" তে গীতি রসের উচ্চসিত প্রবাহ, আবার রাধাকৃষ্ণ বড়াই এর উক্তি প্রত্যুক্তি তে নাটকীয় চরিত্র লক্ষণ প্রকাশ পায়। 
  3. আদি মধ্যযুগের সমাজ চিত্রের বিশ্বস্ত দলিল হল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। বালিকা রাধার সংসার করার মধ্য বাল্যবিবাহের নজির আছে। বিভিন্ন পেশার মানুষের পরিচয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে যেমন আছে তেমনি জনজীবনের অজস্র সংস্কারের নিদর্শন এই কাব্যে দেখা যায়। 
  4. ধর্মাশ্রয়ী কাহিনী হলেও তুর্কি আক্রমণের প্রভাব যাতে অলৌকিকতার আভাস দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে। তাই বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যের কৃষ্ণ সমস্ত অলৌকিক আবরণ সরিয়ে ফেলে একান্তভাবে হয়ে ওঠে এক গোয়ালা যুবক। তাই অনায়াসে কৃষ্ণের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে - "রাধা না পাআ মোর বেআকুল মনে।"
  5. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক প্রেম মূলক কাব্য যা আধুনিক যুগের কাব্য গুলিতে তার প্রভাব ফেলেছে। গ্রাম্য নর-নারীর প্রেম এ কাব্যের প্রাণ তাই কখনো কখনো স্থূল রসের পরিচয় দেখা গেলেও তা কাব্যকে অতিক্রম করেনি ।
  6. আদি মধ্যযুগের সৃষ্টি নব্য বাংলা ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণগুলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে পাওয়া যায়। যেমন সর্বনামের কর্তী কারক এ রা বিভক্তি যোগ, আবার ভবিষ্যতের কর্তৃবাচ্যে ইব অন্তঃক্রিয়া ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। 
    শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাপর্টি আদি মধ্যযুগের সাহিত্যের নিদর্শন হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কাব্যখানি আঙ্গিকগত ও ভাষাগত বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে আছে।


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচনাকাল ও কাব্যটির বিষয়েও আঙ্গিকগত মূল বৈশিষ্ট্য লেখ।


   শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি কবে রচনা হয়েছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিভেদ আছে কারণ গ্রন্থের মধ্যে কোন রচনাকাল এর উল্লেখ নেই। তবে লিপি বিশারদদের বিচারে কাব্যটি চতুর্দশ থেকে 16 শতকে র মধ্যে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' রচিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেছেন। বিষয়বস্তুর দিক থেকে বিচার করে পণ্ডিতেরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সময় কাল নির্ণয় করেছেন চৈতন্য পূর্ব যুগ কে।


 কারণ বড়ু চন্ডীদাসের রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা তে দেহ ভাবনা প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু চৈতন্য সমসাময়িক বা চৈতন্য পরবর্তী সময়ের প্রেম বিলাতে দেহ ভাবনাহীন লাবণ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই কারণে মনে করা হয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি চৈতন্য পূর্ব যুগের রচিত। তা না হলে চৈতন্য পরবর্তী সময়ের রচনা তে এত স্থূল রসের আবেশ রাশি কে অপরাধ বলে মনে করা হতো। 

   কাব্যটির বিষয়েও আঙ্গিকগত দিক অন্যান্য সকল মধ্যযুগের কাব্য কবিতা থেকে অনেক আলাদা। বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের বিষয় হয়ে উঠেছে রাধা ও কৃষ্ণের কাহিনী। যা সমস্ত মধ্যযুগের কাব্য কাহিনীতে দুর্লভ। মধ্যযুগের একমাত্র বৈষ্ণব পদাবলীতে প্রাকচৈতন্য যুগের এই ধরনের রচনা দেখা গেলেও তা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে আলাদা। আর পরবর্তী চৈতন্য যুগের কৃষ্ণ লীলা গুলি ভক্ত ভগবানের আকুতি মিনতি পর্যায়ে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি নাট্য আঙ্গিকে গীতিকাব্য। তিনটি চরিত্র বিভিন্ন সংলাপ বা কথোপকথনের মধ্য দিয়ে কাব্যটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। 

   শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যটির আঙ্গিকগত যে সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা হল - 

  • বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধা কৃষ্ণের লীলা কে অবলম্বন করে লেখা। এটি একটি আখ্যানকাব্য যার বিন্যাসে নাটকীয়তা আর গীতিময়তা লক্ষ্য করা যায়।
  • শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভাষা প্রথম যুগের বাংলা ভাষা হলেও চর্যাপদের ভাষার আরষ্টতা অনেকখানি কম লক্ষ্য করা যায়।
  • ভাগবত পুরাণ এবং গীতগোবিন্দম্ কাব্যের ভাবানুবাদ বড়ু চন্ডীদাস তাঁর কাব্যে ব্যবহার করেছেন। 
  • আদি মধ্যযুগের সৃষ্টি হওয়া নব্য বাংলা ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণগলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে আমরা লক্ষ্য করি। 
  • সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের অনুসরণে বড়ু চন্ডীদাস তাঁর কাব্যে উৎপ্রেক্ষা উপমা রূপক অলংকার ব্যবহার করেছেন।।
  • শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি ছন্দ ব্যবহারেও যথেষ্ট প্রশংসার যোগ্য। কাব্য টি তে কবি বড়ু চন্ডীদাস সাত প্রকার পয়ার ও তিন প্রকার ত্রিপদি ছন্দের প্রয়োগ করেছেন। 
     বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ। এই কাব্যটি থেকে যে সকল প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ সে সকল প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করা হলো এ ছাড়া অন্য সকল প্রশ্নের উত্তর যদি প্রয়োজন হয় কমেন্ট বক্সে লিখলে তার উত্তর যথাসময়ে দিয়ে দেওয়া হবে আর সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এখানে আপডেট করে দেয়া হবে। 

MORE QUESTION AND ANSWERE