শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা কি। বৈষ্ণব পদাবলীতে বাল্য লিলার শ্রেষ্ঠ কবি সম্পর্কে আলোচনা করো
বৈষ্ণব পদাবলীতে পঞ্চরসের সমাহার ঘটেছে। এরমধ্যে বাল্য রস দ্বারা বৈষ্ণব কবিরা যে সকল পদ গুলি রচনা করেছে তা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা পর্যায়ের পদ। প্রায় সকল কবি কৃষ্ণ ও রাধার বাল্যলীলা সম্পর্কে পদ রচনা করলেও তার মধ্যে কোন কোন কবি এই পর্যায়ের পদ এর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। এখানে আমরা শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা ও সেই বাল্যলীলা শ্রেষ্ঠ কবি কে নিয়ে আলোচনা করলাম। প্রয়োজনে আপনি এখান থেকে নোট আকারে তা লিখতে পারেন।
শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা কি
বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে বাৎসল্য রসের পর্যায়ে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা বিষয়ক কিছু পদ আছে। এখানে ভগবানের সঙ্গে ভক্তের পাল্য-পালক সম্পর্ক। ভগবানের ঐশ্বর্যগুণ এখানে অনুপস্থিত। বাৎসল্য রসকে অবলম্বন করে যে ঈশ্বর সাধনা, সেখানে ঈশ্বর সন্তানতুল্য। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে পঞ্চরসের মধ্যে বাৎসল্যের স্থান চতুর্থ। কৃপারযোগ্য কোনো ব্যক্তির প্রতি কৃপাকারী শ্রীভগবানের ঐশ্বর্যভাবশূন্য, সম্ভ্রমলেশহীন রতিকে বলা হয় ‘বৎসল’। উপযুক্ত বিভাব-অনুভাবের মিলনে এই ‘বৎসল’ রতিই পরিণত হয় ‘বাৎসল্য’ রসে।
বাৎসল্যের চারটি বৈশিষ্ট্য – মমত্ববোধ, বিশ্বাস, সেবা ও নিষ্ঠা। এখানে মমতার আধিক্যের ফলে ভগবানকে তাড়না, ভর্ৎসনা, বন্ধন প্রভৃতিও করা হয়। যশোদা-নন্দ, দেবকী প্রভৃতি কৃষ্ণের গুরুজনেরা এই রসের আশ্রয় অবলম্বন। শিশুসুলভ চাপল্য, শিশুক্রীড়া প্রভৃতি এর উদ্দীপন বিভাব। এর অনুভাব হল কৃষ্ণকে লালন ও প্রতিপালন। বাৎসল্য রসেও আটটি সাত্ত্বিকভাবের বিকাশ হয়। এখানে মা যশোদার কাছে শ্রীকৃষ্ণ স্নেহভাজন পুত্র। পুত্রের প্রতি মাতার ভর্ৎসনা, তাড়না ও গঞ্জনা যেমন থাকে তেমনি মাতৃহৃদয় পুত্রের অমঙ্গল চিন্তায় সর্বদা আতঙ্কগ্রস্তও থাকে। ঐশ্বর্যময় ঈশ্বরের স্বরূপবিস্মৃত জননী যশোদার স্নেহশঙ্কাতুর মাতৃহৃদয়ে প্রধানত বাৎসল্য উৎসারিত হয়।
![]() |
Educostudy.in/বাল্যলীলা |
বৈষ্ণব বাৎসল্য রস নিছক লীলারস; পূর্ণ আনন্দের রসপ্রাণ। এতে বিচ্ছেদ নেই, যন্ত্রণা নেই। গোষ্ঠ গমন ইত্যাদিতে যেটুকু যাতনা তা কেবল মাতৃহৃদয়ের এবং মায়ের প্রাণ ঐরকম আকুল হবেই। চৈতন্যপরবর্তী যুগেও বাৎসল্যরস নিয়ে অনেক পদ রচিত হয়েছে। এর কারণ একদিকে শ্রীচৈতন্যের ভাগবতীয় ভক্তিধর্মের প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে পুত্র বিরহিনী জননী শচী ও শ্রীগৌরাঙ্গের প্রত্যক্ষ বাৎসল্য সম্পর্ক।
শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার শ্রেষ্ঠ কবি
বাৎসল্য রসে পদ রচনায় বলরাম দাসই সবচেয়ে বেশী কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। একথা ঠিক যে বৈষ্ণব বাৎসল্য রসের পদে অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্বের আসনটি কেউই গ্রহণ করতে পারেননি। বাৎসল্য রসের চর্চায় যদুনাথ দাস, রায়শেখর, যাদবেন্দ্র দাস, মাধব দাস, ঘনরাম প্রমুখ কবিগণ দু-একটি ক্ষেত্রে বলরাম দাস অপেক্ষা উৎকর্ষতার পরিচয় রেখেছেন। কিন্তু সামগ্রিকতার বিচারে বাৎসল্য রস পর্যায়ে বলরামদাসের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতেই হয়। বলরাম দাস হৃদয়াবেগের স্বর্ণমুহূর্ত সৃষ্টি অপেক্ষা বর্ণনার দিবালোককেই অধিক বিশ্বাস করতেন। সংহত গম্ভীর ও উচ্ছ্বাস বিহীন ভঙ্গিতে তিনি বর্ণনা করে যান। তাঁর এই বৈশিষ্ট্য বহু ক্ষেত্রে ব্যর্থ আলঙ্কারিক চতুরালি অপেক্ষা পাঠকের মন বেশী আকর্ষণ করে।
শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণের বয়সকে তিনভাগে ভাগ করেছেন।
- পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত কৌমার
- দশ বছর বয়স পর্যন্ত কৌগণ্ড
- পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত কৈশোর
বলরাম দাস কৃষ্ণের জন্মসময় অর্থাৎ কৌমার কাল থেকেই বাল্যলীলার পদ রচনা করেছেন। বাৎসল্যের নিপুণ রূপকার বলরাম দাসের রচিত পদগুলি বালক কৃষ্ণ ও মা যশোদার স্নেহে, আবেগে, অভিমানে কৃষ্ণের বাল্যকালীন নানা মধুর চাপল্যে অমৃতরস সিঞ্চিত। বৃন্দাবনে নয়, যেন বাংলাদেশেরই পারিবারিক পরিবেশের আবেষ্টনীতে মাতা ও সন্তানের চিরকালীন মমত্ব বিজড়িত সম্পর্কের সূক্ষ্ম বৈচিত্র্য কবির কাব্যপটে উজ্জ্বল অথচ স্নিগ্ধ তুলিতে আঁকা। বলরাম দাস স্নিগ্ধরসের কবি। তাঁর কবিতা দুটি চরিত্র। সন্তান কৃষ্ণের মঙ্গল চিন্তায় সদাশঙ্কাতুর স্নেহবিমুগ্ধা জননী যশোদা ও মাতৃস্নেহে সিঞ্চিত গোপাল কৃষ্ণ।
বলরাম দসের একটি পদে অভিমান-ক্ষুব্ধ বালগোপাল পিতা নন্দের কাছে মায়ের নামে নালিশ করেছেন –
দাঁড়াইয়া নন্দের আগে গোপাল কান্দে অনুরাগে
বুক বাহিয়া পড়ে ধারা।
না থাকিব তোমার ঘরে অপযশ দেহ মোরে
মা হইয়া বলে ননী-চোরা।
অভিমানী বালক নন্দরাজকে কেঁদে কেঁদে বলছে মা হয়েও যশোদা তাকে চোরের অপবাদ দিয়েছেন। বালক কৃষ্ণের অভিমানও বড় তীব্র। যশোদা তাকে ছাঁদন দড়িতে বেঁধে রেখেছে আর তাই দেখে গোপরমনীরা হাসাহাসি করছে। সে ননী খায়নি অথচ মা তাকে মিথ্যে করে চোর বলছে। এই দুঃখে সে যমুনা পার হয়ে চলে যাবে। গোটা পদটিতে মায়ের প্রতি কৃষ্ণের এই অভিমানে মাতা-পুত্রের স্নিগ্ধ মধুর বাৎসল্য সম্পর্ক ব্যঞ্জনা লাভ করেছে।
কৃষ্ণের গোষ্ঠ যাত্রার উদ্যোগ, যাত্রার আগে যশোদার বিবিধ সাবধান বাণী, সান্ত্বনাহীন আশঙ্কা, মাঠে কৃষ্ণের নিরাপত্তার ভাবনা, শ্রীদাম-সুদাম-দামকে শ্রীকৃষ্ণের নিরাপত্তার জন্য মিনতি ইত্যাদি প্রকাশ পেয়েছে এই পদটিতে –
শ্রীদাম সুদাম দাম শুন ওরে বলরাম
মিনতি করি তো সবারে।
বন কত অতিদূর নব তৃণ কুশাঙ্কুর
গোপাল লইয়া না যাইও দূরে।
কৃষ্ণ এবং তার সখারা গোষ্ঠ যাত্রার জন্য প্রস্তুত। মা যশোদা উদ্বেগ অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুত্রকে গোচারণে পাঠাচ্ছেন। কৃষ্ণের সখাদের তিনি বারবার করে কৃষ্ণের নিরাপত্তার কথা বলছেন। কৃষ্ণের পায়ে তৃণাঙ্কুর বেঁধার ভয়েও তিনি আতঙ্কিত। তিনি কৃষ্ণকে সখাদের মাঝখানে করে নিয়ে যেতে বলছেন। এই অন্ধস্নেহ জননীকে স্বার্থপর করে তুলেছে। পুত্রের জন্য মাতার এই স্বার্থপরতা স্নেহপূর্ণিমায় কলঙ্কের মতো – বড় মনোহর, বড় মধুর। এই যশোদা স্বামী-সন্তান, স্বজন –পরিজনে ঘেরা তাঁর একান্ত মমতায় গড়া সংসারের সীমাতেই তাঁর প্রাত্যহিক দিন যাপন করেন। এখানে তিনি সীমা-স্বর্গের ইন্দ্রাণী।
প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন
গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের রস-সাধক ভক্তকবি বলরামের পদে আঁকা এই যশোদা আমাদের কাছাকাছি, নিজস্ব একটি চরিত্র। এই মায়ের ভীরু ভালোবাসার টানে অকৃত্রিম বাৎসল্যরস – সাধনার আকর্ষণে যিনি অসীম অনন্ত তিনিও মায়ের স্নেহাঞ্চলে ধরা পড়েছেন। শাক্ত পদাবলীতে চিহ্নিত মা আর সন্তানের সম্পর্কের বিপরীতে আছে নিষ্ঠুর সমাজের বিধিবিধান। তাই শাক্তপদাবলীর মাতৃহৃদয়ের বেদনা পারিবারিক গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়।
দেশ-কাল নির্বিশেষে নানা বিচিত্র বিধিবিধানের যুপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত অসংখ্য মানুষের আর্তনাদ এতে মিশে আছে। আর বৈষ্ণব পদাবলীর জননীর বাৎসল্য দেশকাল নির্বিশেষে হলেও বিশেষ করে বাঙালী পারিবারের মাতা ও সন্তানের সহজ স্বাভাবিক প্রাত্যহিকতার উপর প্রতিষ্ঠিত। বলরাম দাসের এই বাৎসল্য বর্ণনায় অনায়াস মাধুর্য নির্গলিত। তাঁর আঁকা মা যশোদা আমাদের পরিচিত গৃহাঙ্গনের মাতৃমূর্তি আর পরম ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ তারই সন্তান। এই চিত্রাঙ্কনেই কবির কৃতিত্ব।
👉👉 উপরে বৈষ্ণব পদাবলীর বাল্য রস দ্বারা রচিত বাল্য লীলার পদগুলি ও এই শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা কি এবং বাল্যলীলা পর্যায়ের বিখ্যাত কবি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তবে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। এবং অনান্য বাংলা সাহিত্যের প্রশ্ন পেতে নিচের প্রশ্নগুলির দেখতে পারেন।
Thank you helpful 😌
উত্তরমুছুনThank you for your support ☺
উত্তরমুছুন