হাঁসুলী বাঁকের উপকথা | তারকশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় | Hasuli Banker Upokotha

 হাঁসুলী বাঁকের উপকথা  – কোপাই নদীর তীরে যেখানে নদীটি হাঁসুলীর মতো বাঁক নিয়েছে সেই বাঁশবাঁদি গ্রামের অন্ত্যজ শ্ৰেণীর মানুষ কাহারদের বিচিত্র জীবনযাত্রার মধ্যে আধুনিক জীবনের আগমন এক বিপ্রতীপ ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। প্রাচীন কৃষি-ব্যবস্থানির্ভর জীবনে যন্ত্রসভ্যতার আবির্ভাবে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কাহারদের লৌকিক বিশ্বাস, অলৌকিক জগৎ, সংস্কারভাবনা, পূজা-পার্বণ, শিকার-উৎসব, সঙ্গীত বশি এর মধ্যেই যে তাদের সংস্কৃতি তাকে লেখক তন্নিষ্ঠ বাস্তবতায় চিত্রিত করেছেন। তাঁর অনেক লেখার মতো হাঁসুলী বাঁকের মানুষদের কাছ থেকে দেখেছেন। ‘আমার সাহিত্যজীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন–‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথার মানুষদের পর্যন্ত আমার এইভাবে জানার সুযোগ হয়েছিল ওই সুচাঁদ এবং আমি বসে গল্প করেছি আর বিড়ি টেনেছি।’ ১৩৫৩-র শারদীয়া আনন্দবাজারে এই উপন্যাসটি বেরিয়েছিল। অবশ্য ওই বছর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দরুন অক্টোবর মাসে পত্রিকা প্রকাশিত হয় নি, হয়েছিল ডিসেম্বর মাসে। ১৩৫৪ সনে বেঙ্গল পাবলিশার্স গ্রন্থাকারে উপন্যাসটি বের করে। এটি উৎসর্গ করা হয়েছিল কবিশেখর কালিদাস রায়কে। ( Credit - Bangla Library


“দেবতায় শিস দিচ্ছেন চলে যাচ্ছেন তাই জানিয়ে দিচ্ছেন”— তাৎপর্য ? 


     মাটি ও মানুষের জীবনকাব্য রচনায় সিদ্ধহস্ত তারকশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলিবাকের উপকথা উপন্যাসের প্রারম্ভিক একটি নির্দিষ্ট সৃষ্টি কেন্দ্র করে অতি প্রাকৃতিক পরিবেশ রচনা করা হয়েছে। আঞ্চলিক উপন্যাসের ঐতিহ্য মান্য করে লেখক লোকজীবনের অন্ধবিশ্বাসকে লোকায়িত করেছেন। অশিক্ষিত সংস্কারাচ্ছন্ন কাহার গোষ্ঠী, কাহার নদী তীরবর্তী অরণ্য প্রদেশে উৎপন্ন বিষয়টিকে দেবতার ক্রোধ রূপে প্রতিপন্ন করে নির্দেশ করেছে।“ কালারোদ্দুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত পানুর খুত পাঠকে বাবুরা এর তদন্ত করে বিফল হয়েছেন ”। পানু তার বৃত্তান্তের লৌকিক সংস্কারকে আরো বেশি করে বিবৃত করেছে আর সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছে আদ্দিকালের বুড়ি সু চাঁদ। এই অতিপ্রাকৃত ভয়াত পরিবেশ সৃষ্টিতে তারক সংকটের বর্ণনা আমোঘ ও চিত্রধর্ম সম্বলিত নির্দিষ্ট সীমারেখায় ঘেরা স্থানে ধর্ম যে কি ভয়াবহ পরিস্থিতির সূচনা করতে পারে এবং তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মানুষের জীবনে এরকম বিপর্যয়ের সূচনা হতে পারে তার অভিনব রুপায়ন ঘটিয়েছেন তিনি।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথা | তারকশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়  | Hasuli Banker Upokotha


‘হাঁসুলিবাকের দেশ করাতের দেশ’— তাৎপর্য লেখ ।


     আঞ্চলিক উপন্যাসের সার্থক রূপকার তারক শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে একটি বিশিষ্ট অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশের বিশস্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন। এখানে সমগ্র ঘটনার কেন্দ্রভূমিতে রয়েছেন বীরভূম জেলার জঙ্গল ভূমি রাঢ় অঞ্চল। এক সময় এটি ছিল সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান। কোপাই নদীর তীরবর্তী করাঘাতের মাটি গ্রামটির নাম বাশবাদী। কঠাক মৃত্তিকায় গাঁইতি চালিয়ে গড়ে উঠেছে পদাতিক কাহাদের অর্থনৈতিক জীবন। ‘ কোদাল ’ আর ‘ টামনে ’তাদের জীবনে কর্নের কবজ কুণ্ডল হয়ে উঠেছে। মাটির সঙ্গে লড়াই করে এখানে ফসল ফলাতে হয় সূর্যের প্রবল দাবদাহে মাটির স্নিগ্ধতা যায় হারিয়ে, তখন নদী হয়ে ওঠে একমাত্র আশ্রয়।



‘কোপাই নদী ঠিক যেন কাহার কন্যে’— তাৎপর্য লেখ ।


     প্রখ্যাত আঞ্চলিক উপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অন্যতম উপন্যাস ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথায়’ প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছেন। মানবসত্তার স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির প্রকাশ রূপে এখানে কোপাই নিছক নদী নয় কাহার সমাজে কন্যারূপে প্রতিষ্ঠিত। নদীর আষাঢ় মাস থেকেই মা-বাবা ছোট মেয়ের মত ক্রমবর্ধিত হতে শুরু করে। যৌবনাক্রান্ত শরীর একদিন হঠাৎ হয়ে ওঠে ‘ডাকিনী’। কাহার সমাজে যেমন হঠাৎ যৌবনের অমোঘ ‘ টানে কুলে শলি ছিটিয়ে ’ প্রবেশ করে আদিম পৃথিবীতে তেমনি করে এই নদী ভাসিয়ে নিয়ে যায় দুই কুলের তীরের সবকিছু, তার বন্যায় ঘরদৌর না ভাঙলেও কাহারদের চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়। এরই মধ্যে এসে উপস্থিত মালোয়ারি স্বর।



‘শেষে ঘটল একটা বীভৎস কান্ড’—তাৎপর্য লেখ।


     মানবজীবনের জ্বলন্ত ভাষ্যকার তারকশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অন্যতম আঞ্চলিক উপন্যাস ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা ’র প্রথম অধ্যায়টি রচনা করেছেন এক অনির্দিষ্ট ‘ শিস ’এবং তাকে কেন্দ্র করে মানুষের বিচিত্র মানসিকতার বহিরপ্রকাশে প্রকটিত করে। অশিক্ষিত সংস্কারাচ্ছন্ন কাহারা বিষয়টিকে দেবতার চক্রান্ত রূপে প্রতিপন্ন করে নির্দেশ করেছেন। কাল রুদ্রের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত পানুর ‘ খুত ’ পাঠকে আধুনিক মনস্ক করালি বিষয়টির অনুসন্ধান করতে গেলে তার কুকুর কালুয়া ( ) ধারাই সিক্ত হয়ে ‘ চোখ দুটো ফুলে ওঠে ফেটে ’ মারা যায়। এই ঘটনায় মাতব্বর বনোয়ারি ভয়ার্ত স্বরে উচ্চারণ করেন যে কর্তা নিশ্চয় খড়মশুদ্ধ বা পাটি কুকুরটির গলায় সংস্থাপন করেছে। এই বীভৎস কাণ্ডে সকলে হতবাক ও বিস্মিত হয়।


‘এই কর্তার কথা অমান্য করতে গিয়েই সাহেব মহাশয় মেমকে নিয়ে তলিয়ে গেল খুরণ চাকির মধ্যে পড়ে’ — তাৎপর্য লেখ ।


     প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক তারকশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র প্রারম্ভেই এক অতিপ্রাকৃত পরিস্থিতির সূচনা করেছেন অনির্দিষ্ট ‘ শিস ’কে কেন্দ্র করে। এর পাশাপাশি আদ্দিকালের বুড়ি সুচাঁদকে অবলম্বন করে তিনি রচনা করেছেন উপকথার জগত। আধুনিকতার স্পর্শে চন্দন পুরের ভদ্র সমাজ মনে করে সেসব কাহারদের রচনা করা উপকথা। যেমন— চৌধুরী কর্তার বাবার বাবা ছিলেন সাহেবদের নায়েব তিনি একদিকে ছিলেন ভাগ্যমন্ত্র অন্যদিকে ‘ জাঁহাবাজ ব্যাটাছেলে ’। তার দাপটে বাঘে-বলোদে এক ঘাটে জল খেতে। তিনি কর্তা অর্থাৎ কালরুদের কৃপা লাভ করেন। তিনি নাকি ‘ গেরুয়া কাপড় ’ পড়ে,খড়ম পায়ে,দন্ড হাতে,গলায় রুদ্রাক্ষ আর ধবধবে পৈতে শোভায় ঝলমলিয়ে ন্যাড়া মাথায় রাত্রে সর্বত্র বিচরণ করেন। একথা চন্দনপুর বাসীর কাছে উপকথা মাত্র আসল ঘটনা হলো তিনটি নীলকুঠির সব জায়গায় যেমন ভাবে উঠেছে, এখানেও সেভাবে উঠেছে,সুচাঁদ বলে বাবার কোপেই একদিন নীলকুঠির সাহেব মেম তলিয়ে গেছে ঘুরন চাকির মধ্যে। এ কথা বনওয়ারি বিশ্বাস করেন। কিন্তু আসল কারণ কোপাইয়ের ভয়ঙ্কর বন ও তার বিধ্বংসী কার্যকলাপ।