কবি কাশীরাম দাসের (kashiram-das) জীবনী | কাব্য রচনা | রচনার মৌলিকত্ব

  বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের ধারায় উল্লেখযোগ্য কবি কাশীরাম দাস ( kashiram-das ), এখানে তার কাব্য, জীবনী ও কাব্য রচনার মৌলিকত্ব সম্পর্কে আলোচনা করলাম। আমরা সাহিত্যের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন গুলি এখানে পর পর আলোচনা করে এসেছি, এখানে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন।।


কাশীরাম দাস

দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের মহাভারত বাংলায় অনুবাদ হয়েছে মধ্যযুগীয় অনেক কবির হাতে, তবু কালের মন্দিরায় বাঙালী জীবনবীনার যথার্থ সুর যোজনা যিনি করতে পেরেছিলেন তিনি কাশীরাম দাস। সেই সুদুর ভারতবর্ষের বিস্মৃত প্রায় অতীতে সংঘটিত ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের পটভূমিকায় মানবজীবন সংঘাতে যে উন্মাদিনী নাগিনীর ফণা বিস্তৃত হয়েছিল বাংলার পলল কোমল মাটিতে বসে অশ্রুত এক গ্রাম্য বিনীত কবি তাকে রূপান্তরিত করেছিলেন দেশকালোচিত মাধুরী মিশিয়ে। বাঙালীর জাতীয় জীবনে তাই কবি কৃত্তিবাসের মতই যুগোত্তীর্ণ লোককান্ত কবি হয়ে উঠেছিলেন এই কাশীরাম দাস।


কবি জীবন

কাশীরাম দাস বর্ধমান জেলার ইন্দ্রানী পরগণার সিংগী বা সিদ্ধি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির বাবার নাম কমলাকান্ত। কবির তিন ভাই। কবি মেদিনীপুর জেলার আলিগড়ের জমিদার বাড়িতে শিক্ষকতা করতেন। কবির উপাধি ছিল দেব। চৈতন্যোত্তর কালের স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী কবিরা ছিলেন বৈষ্ণব ভাবাপন্ন।


কাব্যরচনা

কবির কাব্য রচনার ক্ষেত্রে গুরু অভিরাম মুখুটির আশীর্বাদ প্রেরণ হিসাবে কাজ করেছিল। অষ্টাদশ পর্বের বৃহৎ মহাভারত কবি একা অনুবাদ করেননি। কোনো কোনো পুথিতে একটি শ্লোক পাওয়া যায় –

“আদি সভা বন বিরাটের কতদূর।
ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।।”

বাকিপর্বগুলি হয়তো তাঁর পরিবারের অন্যান্যরা রচনা করেছেন। অবশ্য অন্যান্য কবিরাও এইকাজ করতে পারেন। বিশেষত কৃষ্ণানন্দ বসু নামে একজন কবির উল্লেখ পাওয়া যায়। কবির কাব্য রচনার কাল নিয়েও সংশয় থাকলেও মোটামুটিভাবে মনে হয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকেই কবি তাঁর ‘ভারত পাঁচালী’ রচনা শুরু করেন।


রচনার মৌলিকতা

অনুবাদের ক্ষেত্রে কবির মূলানুগত্য লক্ষনীয়। যেমন আদিপর্বে ৮৮/৫৭ নং শ্লোকটি হল –


“ব্রাহ্মণো দ্বিপাদাং শ্রেষ্ঠো গৌরবরিষ্ঠা চতুষ্পাদম্‌।
গুরুর্গরীয়সাং শ্রেষ্ঠো পুত্রঃ স্পর্শবতাং বর।।”


কবির অনুবাদে –


“চতুষ্পদে গাভী শ্রেষ্ঠ দ্বিপদে ব্রাহ্মণে।
অধ্যয়নে গুরু শ্রেষ্ঠ পুত্র আলিঙ্গনে।।”


সভাপর্বে ৩৭/১৬ নং শ্লোকে বলা হয়েছে –


“জ্ঞানোবৃদ্ধো দ্বিজাতিনাং ক্ষত্রিয়াণাং বলাধিকঃ।
বৈশ্যানাং ধান্য ধনতঃ শূদ্রাণামেব জন্মতঃ।।”


কবির অনুবাদে –


“বিপ্র মধ্যে পূজা পায় জ্ঞানীবৃদ্ধগণ।
ক্ষাত্রমধ্যে পূজা পায় বলবান জন।।
বৈশ্যমধ্যে পূজা পায় ধনী ধান্যজনে।
শূদ্রমধ্যে পূজা পায় বয়োধিক জনে।।”


মূল মহাভারতের অসংখ্য কাহিনী পরিবেশিত হয়েছে। এর মধ্যে শ্যেন-কপোত, অগস্ত্য-লোপামুদ্রা ও ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের কাহিনী কাশীরাম নিয়েছেন। মূল মহাভারতের আদিপর্বের ৮৩ সংখ্যাক অধ্যায়ে দুষ্যন্তের মৃগয়া বর্ণনা কাশীরামের অনূদিত কাব্যে সংক্ষিপ্ত।


কাশীরাম দাসের (kashiram-das) জীবনী
Educostudy.in/kashiram-das


 আদি পর্বের ১৩-১৫ নং অধ্যায়ে সমুদ্রমন্থনের কাহিনীতে বলা আছে অমৃতের উদ্দেশ্যে সমুদ্রমন্থন করা হয়। কাশীরাম লিখেছেন অমৃত নয় লক্ষ্মীর উদ্ধারের জন্য সমুদ্র মন্থন করা হয়। আদিপর্বের ১২৩ নং অধ্যায়ে দুর্যোধনের চক্রান্তে নাগলোকে উপস্থিত বিষজর্জর ভীম রসায়ন পানে সহস্র হাতির বল লাভ করেন। কাশীরামের কাব্যে এ কাহিনী সংক্ষিপ্ত।


শুধু সংক্ষেপ নয়, প্রয়োজনে সংযোজনও করেছেন কবি। সমুদ্র মন্থনের প্রসঙ্গে নারদের পার্বতীকে উত্তেজিত করা পার্বতীর মহাদেবকে উত্তেজিত করা ও মন্থনের সময়ে মহাদেবের উপস্থিত হওয়া কবির মৌলিক কল্পনা। আদিপর্বের ৮৬ নং অধ্যায়ে স্বর্গের চক্রান্তে মেনকা ও রূপমুগ্ধ বিশ্বামিত্রের ঔরসে শকুন্তলার জন্ম ও মেনকার শকুন্তলাকে পরিত্যাগের যে কাহিনী আছে কাশীরাম তার সঙ্গে বিশ্বামিত্রের দাম্পত্য জীবনের উল্লেখ করেছেন।


 দ্রৌপদীর অহংকার এবং অকাল আম্রের বিবরণ, শ্রীবৎস চিন্তার কাহিনী, হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদের কাহিনী মূল মহাভারতে নেই। এগুলি কাশীরামেরই সংযোজন।

কাশীরামের সৃষ্ট চরিত্রগুলি বাহ্য প্রকৃতিতে মূল মহাকাব্যের সঙ্গে অভিন্ন। কিন্তু প্রাণ প্রকৃতিতে পৃথক। আসলে চৈতন্যোত্তর যুগে প্রেমভক্তির আদর্শ কবিকে প্রাণিত করেছে। সেই কারণে তাঁর কাব্যে মহাভারতীয় চরিতের মহাকাব্যিক উজ্জ্বলতা ম্লান, ক্ষত্রিয়ের দার্ঢ্য, বাঙালীর কোমলতায় পর্যবসিত। কাশীরামের যুধিষ্ঠির শক্তিহীন, ধর্মভীরু। নিজের প্রাপ্য পেলে তিনি কৃতার্থ।


 দুর্বলের ক্রন্দন আর আক্ষেপ যুধিষ্ঠিরকে ভাবপ্রবণ বাঙালীতে পরিণত করেছে। মহাভারতে প্রচণ্ড শক্তিমান ভীম কাশীরামের কাব্যে কৃষ্ণসমর্পিত, যদিও বিশালদেহী এবং উদরপরায়ন। মহাভারতের গাণ্ডীবধারী বীর অর্জুন কাশীরামের কাব্যে কৃষ্ণভক্ত মানুষ। অর্জুনের যে রূপ বর্ণনা কাশীরাম করেছেন সেখানে ক্লাসিক রীতির প্রকাশ। যদিও এই শিল্পমূর্তি যতটা না অর্জুনের তার চেয়ে বেশি কৃষ্ণের –


“দেবদ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মূরতি।
পদ্মপত্র যুগ্মনেত্র পরশয়ে শ্রুতি।।
অনুপম তনুশ্যাম নীলোৎপল আভা।
মুখরুচি কতশুচি করিয়াছে শোভা।।”


মহাভারতের দুর্যোধনের ক্ষাত্র শক্তি কাশীরামের কাব্যে দেবদ্বেষে পরিণত। আবার জ্ঞাতিশত্রু হলেও অগ্রজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি তার ভক্তি লক্ষনীয়। মূল মহাভারতের আত্মশ্লাঘাকারী অভিমানী বীর কর্ণ কাশীরামের কাব্যে দুষ্ক্রীতিকারী দাম্ভিক বক্তিমাত্র।


 মূল মহাভারতের সভা ও বিরাট পর্বের ক্রোধ দর্প প্রতিহিংসা রূঢ়তা ও তেজস্বীতার সমন্বয়ে যে মহীয়সী দ্রৌপদীর আবির্ভাব কাশীরামের কাব্যে আক্ষেপে অভিমানে সে তেজস্বিতা তাঁর অন্তর্হিত। কৃষ্ণের বিশ্বরূপ বর্ণনায় কাশীরাম আবার তাঁর Classic কাব্যাদর্শের পরিচয় রেখেছেন –


“সহস্র মস্তক শোভে সহস্র নয়ন।
সহস্র মুকুটমণি কিরীট ভূষণ।।
সহস্র শ্রবণে শোভে সহস্র কুণ্ডল।
সহস্র নয়নে রবি সহস্র মণ্ডল।।”


কৃষ্ণচরিত্র মূল মহাকাব্যের মহত্তম মানবের পরিচয় বাদ দিয়ে হয়ে উঠেছে ভক্তত্রাতা ভগবান।


রসবিচারেও কাশীরাম যথেষ্ট স্বতন্ত্র মূল মহাভারতে বীর, করুণ, রৌদ্র ও মধুর রসের প্রাধান্য। কাশীরামের কাব্যে ভক্তিরস প্রধান। করুণ ও মধুর এখানে অনুষঙ্গি। হাস্যরসে তাঁর অভিনবত্ব লক্ষনীয়।


দেশকালগত পটভূমিতেও মূল ভারতকথা আর কাশীরামের ভারত পাঁচালীর তফাৎ ধরা পড়ে। প্রাচীন ভারতবর্ষে জনজীবন আশ্রিত মহাকাব্য মহাভারত। প্রাচীন ভারতের নবজাগ্রত নাগরিক সভ্যতার ছাপ তাতে স্পষ্ট। এক রাজপরিবারের ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতিতে, রাজনৈতিক উত্থান-পতন এর মুখ্য উপজীব্য।


 কিন্তু কাশীরামের কাব্য সপ্তদশ শতকে চৈতন্যপরবর্তীকালে বাঙালী জীবনের কাব্য। বাংলার সমাজ এ কাব্যের পটভূমি। তাই ক্ষাত্রতেজ দীপ্ত মহাভারত নয়, ভক্তিতে-নৈতিকতায়, আনন্দে-হতাশায় এ কাব্য বাঙালীর ঘরের কথা। সভাপর্বে দ্রৌপদী-হিড়িম্বার কলহের মধ্যে বাঙালী সমাজের দুই সতীনের কহলের ছাপ সহজবোধ্য।


 কৃত্তিবাসী রামায়ণের মত করুণারসের নির্ঝর না হয়েও এ কাব্য চৈতন্যপরবর্তীকালে বাঙালী জীবনের ধ্যান ধারণা ও ভাব কল্পনায় সমৃদ্ধ। বাঙালীর জীবনযুদ্ধের প্রেরণ আছে এখানে। বাঙালীর পরিবর্তমান জীবন প্রবাহের জীবন গীত এ কাব্য।


 অলংকারের বাহুল্য, শব্দের ছটা তার কাব্যে বেশি নেই। মুকুন্দরামের রচনায় এই অনাড়ম্বর সহজতা আমরা দেখেছি। তাই কাশীরামের কাব্য বাঙালী জীবনের অনির্বান Tradition । মধুসূদন দত্ত তাই শ্রদ্ধা অর্পন করে বলেছেন –

‘হে কাশী কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান।’



👉👉  এখানে  আলোচনা করা বিষয়  টি যদি ভালো লাগে তবে নিচে কমেন্ট করবেন। আমাদের আরো সকল প্রশ্ন ও উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইট ফলো করতে পারেন।।