মুসলিম সাহিত্য | কবি দৌলত কাজী | লোর চন্দ্রনি | সতীময়না - সম্পর্কে আলোচনা

বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম বিষয় মুসলিম সাহিত্য যেখানে সমস্ত মধ্য যুগ ধরে হিন্দু দেব-দেবীদের মাহাত্ম্যপূর্ণ কাব্য রচনা হয়েছিল সেখানে বাংলা ভাষার মূল ভূমি থেকে কয়েক শ কিলোমিটার দূরে কয়েকজন মুসলিম কোভিদ হাতে জন্ম নেয় নতুন বাংলা সাহিত্য - মুসলিম সাহিত্য। 


   বর্তমান পূর্ববঙ্গের আরাকান ও রশান রাজসভা কে কেন্দ্র করে এই মুসলিম সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল। মুসলিম সাহিত্যের হাত ধরে বাংলা ভাষা প্রথম দেবদেবীর গন্ডির বাইরে পৌঁছাতে পেরেছে যেখানে মানুষের সম্পর্কের জয়গান গাওয়া হয়েছে। এই সকল কারণে এই মুসলিম সাহিত্য গুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে।

মুসলিম সাহিত্য | কবি দৌলত কাজী | লোর চন্দ্রনি
Educostudy.In/Doulat-kaji


  আজ আমরা এই আলোচনাতে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে গড়ে ওঠা মুসলিম সাহিত্য তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি দৌলত কাজী সম্পর্কে আলোচনা এবং তাঁর রচিত কাব্য সতীময়না নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম - 


দৌলতকাজী

আরাকান রাজসভার সংবর্ধিত শ্রেষ্ঠ কবি দৌলত কাজী / Doulat-kaji। কবির ব্যক্তি পরিচয় ইতিহাসের অন্ধকারে আজও বিলীন। শুধু এটুকু জানা যায় সুফী মতাবলম্বী কবির জন্ম ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে চট্টোগ্রামের সুলতানপুরে। শৈশবেই কবি আরাকানরাজ সুধর্মার সভায় স্থান পায়।


আরাকানরাজের সমরসচিব আশরফ খানের নির্দেশে ও পৃষ্টপোষকতায় ১৬২১-১৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কোন সময় ‘সতীময়না’ বা ‘লোরচন্দ্রানি’ কাব্য রচনা করেন। কাব্যরচনা কালে কবির আকস্মিক মৃত্যু হলে পরবর্তীকালে আরাকান রাজসভার অন্যতম শক্তিশালী কবি আলাওল কাব্যখানি সমাপ্ত করেন।


 মিয়া সাধন নামে জনৈক হিন্দি কবি ‘ঠেটগোহারি’ ভাষায় ‘মৈনা কো সৎ’ নামে যে কাব্য কাহিনী সৃষ্টি করেন কবি দৌলতকাজী সেই কাব্য অবলম্বন করে বাংলা ভাষায় ‘সতীময়না’ বা ‘লোরচন্দ্রানি’ কাব্যটি রচনা করেন। এছাড়া কবি দৌলতকাজী তাঁর কাব্য রচনায় মিয়া সাধন ছাড়াও মুল্লাদাউদ রচিত ‘চন্দায়ন’ কাব্য দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন


সতীময়না কাহিনী

দৌলত কাজীর কাব্যের কাহিনী সংক্ষেপে এইরূপ। গোহারী দেশের রাজা মোহরার সুন্দরী কন্যা চন্দ্রানীর সঙ্গে এক নপুংশক বামনের বিবাহ হয়। ফলত চন্দ্রানী সুখী হয়নি। পরে রাজা লোরকের সঙ্গে সাক্ষাতের ফলে চন্দ্রানী তার প্রতি আকৃষ্ট হন। লোরকের ময়নামতী নামে আরেক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সে চন্দ্রানীকে নিয়ে পালিয়ে যায়।


 পথে বামন তাকে আক্রমণ করলে লোর তাকে বধ করেন এবং অনুরোধে গোহারীর রাজা হন। এদিকে সতী স্ত্রী ময়না পতিবিরহে দুঃখে কাল কাটাচ্ছিলেন। এদিকে ছাতন নামে এক লম্পট রাজকুমার ময়নাকে পাবার জন্যে রওনা নামক এক কুটনীকে প্রস্তাব দিয়ে ময়নার কাছে পাঠায়। রওনার কোন প্রলোভনে ময়না আকৃষ্ট হয়নি, বরং বলেছে –


যবে ইহলোকে 		না মিলে লোরকে
পরলোকে হইব সঙ্গী।

রওনা বারোমাসের যৌবনসুখের বর্ণনা দিয়ে আষাঢ় থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী বছরের জৈষ্ঠ্যের কথা আরম্ভ করতেই কাব্য খণ্ডিত হয়েছে। কবি কাব্য অসমাপ্ত রেখেই পরলোকে গমন করেন। পরবর্তীকালে সৈয়দ আলাওল লোরচন্দ্রানীর অসমাপ্ত অংশ সমাপ্ত করেন। এই অংশে দেখা যায় লোরক ও চন্দ্রানী তাঁদের পুত্রসহ সতীময়নার কাছে প্রত্যাবর্তন করছেন।


দৌলতের কাহিনী মৌলিক না হলেও তিনি কাহিনী বিন্যাসে যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা স্বীকার্য। বস্তুতপক্ষে দৌলতকাজী মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ কাব্যের স্রষ্টা। মর্ত্যজীবনের অসাম্প্রদায়িক কাব্য রচয়িতা তিনি। মুসলিম কবি হয়েও হিন্দুর কাহিনীতে হিন্দু কবির মতই তিনি বলে গেছেন। হিন্দু যোগসাধনার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। তিনি লিখছেন –


নয়ন মুদিয়া 		পাতাল দিয়া
দৃষ্টি চন্দ্রমূলে রাখি
স্থলে ডিম্ব রাখি 		জলে কূর্ম থাকি
কূর্মে ডিম্বে দৃষ্টি ধরে।।

এই কাব্যের সবচেয়ে বড় দিক কবির আদ্যন্ত জীবনরসিকতা। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এই মাটির মানুষের জয়ধ্বনি কবির কাব্যে আছে –


নিরঞ্জন সৃষ্টি পর অমূল্য রতন।
ত্রিভুবনে নাহি কেহ তাহার সমান।।
নর বিনে চিন নাহি কিতাব কোরান।
নর সে প্রম দেব তন্ত্রমন্ত্র জ্ঞান।।


এই মানবতাবাদী উক্তি আসলে মরমী সূফি সাধনার জীবনবেদ। এই কাব্যের কাহিনী রূপকথা ধরণের এবং রোমান্সধর্মী। সতীময়নার অচঞ্চল সতীত্ব আর তারই পাশে চন্দ্রানীর যৌবনোচ্ছ্বল মূর্তি চারিত্রিক Contrast তৈরী করেছে।


 তার আদর্শ নারী ময়না, Type চরিত্র আর চন্দ্রানী জীবনচাঞ্চল্যে ভরপুর। লোরের চরিত্রাঙ্কনেও বাস্তবধর্মী নায়কের গুরুত্ব বেশী। তার মতো পয়ার ত্রিপদীর বন্ধন সেকালে অনেকেই সৃষ্টি করতে পারেননি। যোগীর বর্ণনায় কবি বলছেন –


জটাধারী ব্যাঘ্রচর্ম বিভূতিভূষণ।
কণ্ঠে রুদ্রমালামূর্তি যেন ত্রিনয়ন।।
জলন্ত প্রদীপ দীপ্তি দিব্য কলেবর।
আগানলে দহিছে সকল অভ্যন্তর।।


যুদ্ধ বর্ণনায় কবি যেন কাশীরাম দাসের চেয়েও উৎকৃষ্ট। ‘গীতগোবিন্দে’র আদর্শে বাংলা ও সংস্কৃত মিশিয়ে যে পদ তিনি রচনা করেছেন তা মাঝে মাঝে বৈষ্ণব মহাজনদের স্মরণ করিয়ে দেয়। স্বর্গের হাতছানি না দিয়ে বাস্তবতার সৃষ্টিতে তিনি অনাগত আধুনিকতার প্রভাতী গায়ক।


 বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতা ভেঙেছেন তিনি। মর্ত্য ও মানুষের জয়গানে মুখর তার কাব্যবাণী। অসমাপ্ত কাব্য রচনার মধ্যেও তিনি নবজীবনের ব্যঞ্জনা দান করেছেন যা বাংলা সাহিত্যে অতীব মূল্যবান।



👉👉   মুসলিম সাহিত্য কবি দৌলত কাজী ও তার রচিত সতীময়না / লোরচন্দ্রানী কাব্য নিয়ে আমরা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, এটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তবে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট করে জানাবেন ও প্রয়োজনে আমাদের ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখতে পারেন ।