কবি সৈয়দ আলাওল | মুসলিম সাহিত্য | পদ্মাবতী | পদুমাবৎ - সম্পর্কে আলোচনা

   বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের আরাকান রাজসভা কে কেন্দ্র করে যে সাহিত্য সম্ভার সৃষ্টি হয়েছিলো তার অন্যতম সৃষ্টি কর্তা ছিলেন কবি সৈয়দ আলাওল। এখানে আজ আমরা কবির কাব্য সম্পর্কে ও কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা করলাম। 


সৈয়দ আলাওল

আরাকান রাজসভার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ আলাওল। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে চট্টগ্রামে কবির জন্ম এবং মনে হয় ১৬৭৩ খ্রীষ্টাব্দে তার মৃত্যু। কবির জীবন সৌভাগ্যের আনন্দে আর দুর্ভাগ্যের দুর্দশায় বড়ই বিচিত্র। সুনিপুণ যোদ্ধা কবি মগরাজের সেনাবাহিনীতে চাকরি নেন। অল্পকালের মধ্যে আরাকানের মুসলিম সমাজে তার কবি প্রতিভার কথা ছড়িয়ে পড়ে।


 আরাকানের বিচারপতি মামুদশার আনুকূলে তিনি রাজসভায় স্থান পান। আলাওল বহু কাব্য রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে পদ্মাবতী (১৬৪৬), ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জমাল’ (১৬৫৮-৭০), লোরচন্দ্রানীর শেষাংশ (১৬৫৯), হপ্ত পয়কর (১৬৬০), তোহফা (১৬৬৩-৬৯), সেকান্দারনামা (১৬৭২) ইত্যাদি বিশেষ পরিচিত।


 বিশেষত ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের জন্য মধ্যযুগের কবি সমাজে আলাওল বিখ্যাত হয়ে আছেন। অবশ্য এটি তাঁর মৌলিক রচনা নয়, প্রসিদ্ধ হিন্দি কবি মালিক মহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্যের অনুসরণে লেখা।


কাব্যের কাহিনী

জায়সীর যে কাহিনীটি আলাওল অনুবাদ করেছিলেন তা সংক্ষেপে এইরূপ। চিতোরের রানা রত্নসেন এবং প্রথমা পত্নী নাগমতী রাজা হিরামল পাখির কাছে সিংহল রাজকন্যা পদ্মাবতীর রূপের কথা শুনে সিংহলে এসে উপস্থিত হন এবং পদ্মাবতীর সাক্ষাৎ লাভ করেন।


 গোপনে পদ্মাবতীর সঙ্গে মিলিত হবার চেষ্টা করলে সিংহলরাজ গন্ধর্ব সেন তাকে আটক করে শূলে দিতে যান। এসময় দেবতাদের হস্তক্ষেপে রত্নসেনের পরিচয় পেয়ে সিংহলরাজ পদ্মাবতীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেন। প্রথমাপত্নী নাগমতীর বিরহের কথা শুনে রাজা পদ্মাবতীসহ চিতোর ফিরে আসেন।


 কিন্তু ‘চিরদিন কাহার সমান নাহি যায়’। দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দিন পদ্মাবতীর রূপের কথা শুনে চিতোর আক্রমণ করেন এবং পদ্মাবতীকে কেড়ে নেবেন মনে করে চিতোর অবরোধ করেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সিদ্ধি হল না। রত্নসেনকে বন্দী করে আলাউদ্দিন দিল্লীতে নিয়ে গেলেন।


 কিন্তু গোরা ও বাদল নামে দুই রাজভক্ত রাজপুত রত্নসেনকে উদ্ধার করল। বাদশাহী যোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধে গোরা প্রাণ দিলেন। নিজের মৃত্যুকাল নিকটে জেনে রত্নসেনকে বাদলের ওপর চিতোর রক্ষার ভার দিয়ে প্রাণত্যাগ করলেন। নাগমতী ও পদ্মাবতী সহমৃতা হলেন। আলাউদ্দিন পদ্মাবতীকে পেলেন না তবে চিতোরগড় অধিকার করলেন।


জায়সীর কাব্যটি আসলে একটু রূপক কাব্য, সূফী সাধনার তত্ত্ব ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে রচিত। আলাওল কিন্তু জায়সীর আধ্যাত্মতত্ত্বের কথা ততটা গ্রহণ করেননি। তাঁর ‘পদ্মাবতী’ অনেকটা মানবপ্রেমের কাহিনী। যদিও সুফী মতাবলম্বী হবার কারণে মধ্যযুগের রোমাণ্টিক মানব প্রেমের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার একটি প্রচ্ছন্ন যোগ রচনা করেছেন। কবি লিখছেন -


প্রেম বিনে ভাব নাহি ভাব বিনে রস।
ত্রিভুবনে যত দেখ প্রেম হন্তে বস।।
যার হৃদয়ে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর।
মুক্তিপদ পাইল সে সবার ঠাকুর।।


আলাওল জায়সীর কাব্যের অনুবাদের সময় অনেকক্ষেত্রেই আক্ষরিক অনুবাদ এনেছেন। কোথাও কোথাও অবশ্য ঘটনা চরিত্র বর্ণনায় নিজস্বতা এনেছেন। আসলে আলাওলের লক্ষ্য ছিল বিশুদ্ধ মর্ত্যপ্রেম। তাই জায়সীর কাব্যের পরিবর্তন প্রয়োজন অনুসারে করতে দ্বিধা করেননি।


 জায়সী যেখানে চৌপাই এবং দোহা ছন্দ ব্যবহার করেছেন আলাওল সেখানে পয়ার-ত্রিপদী ছন্দই ব্যাবহার করেছেন বেশি। জায়সী সংস্কৃত শ্লোক ব্যবহার করেননি। সংস্কৃতাভিজ্ঞ কবি আলাওল সংস্কৃত শ্লোক ব্যবহার করেছেন। কিন্তু জায়সী যেখানে পুরাণের বর্ণনা করেছেন, আলাওল সেখানে কোরান লিখেছেন।


কবি সৈয়দ আলাওল
Educostudy.In/Saieed-Alaol


 দুজনেই মূর্তিপূজার কথা বলেছেন কিন্তু এবিষয়ে জায়সীর উদারতা ও সংযম আলাওলের চেয়ে বেশি। জায়সী মুসলমান সম্প্রদায়ের কথা কোথাও বলেননি কিন্তু কোথাও কোথাও আলাওল মুসলমান জাতির প্রতি বেশি দৃষ্টি দিয়েছেন। তবু আলাওলের কাব্যে অনুবাদজনিত আড়ষ্ঠতা নেই।


 যদিও ডঃ কালিকারঞ্জন কাননগোর মতে কাব্যটি যথেষ্ঠ ত্রুটিযুক্ত। তবু আমাদের মনে হয় যে আলাওল তার সাধ্যমত রূপকথাধর্মী সরসতা পরিচ্ছিন্নতা রাখতে পেরেছেন। সর্বোপরি জায়সী যেখানে উত্তর ভারতীয় সমাজের প্রসঙ্গ টেনেছেন। আলাওল সেখানে বাংলার আচার-আচরণ, রীতি-নীতিকে তুলে ধরেছেন। তাঁর স্ত্রী চরিত্রগুলো যতটা-না রাজপুত তার চেয়ে বেশি বাঙালী।


 তবে তার মানে এই নয় যে পদ্মাবতী আলাওলের নিজস্ব সৃষ্টি। একথা ঠিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তিনি মানুষের কথা বলেছেন। একথাও সত্য যে শাস্ত্রজ্ঞ কবি জীবনের বহুপাত্র থেকে তিল তিল নিয়ে তিলোত্তমা গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু সৃজন ক্ষমতা তার প্রতিভার সমতুল্য ছিল না। তাই তাঁর পদ্মাবতী শিল্পসৃষ্টি হিসাবে বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় মাইলস্টোন হয়ে উঠতে পারল না। দৌলতকাজী সেক্ষেত্রে আলাওলের চেয়ে সফল।


বাংলা অনুবাদ সাহিত্য ধারায় দৌলত কাজী / আলাওল এর সাহিত্যকীর্তি এক অসামান্য সৃষ্টি। যে ভূমিতে দাঁড়িয়ে তাঁদের কাব্য রচনা সে ভূমিও তখন অপ্রস্তুত। মঙ্গল কাব্যের গোরুরগাড়ীর অনন্তযাত্রা আর বৈষ্ণব কাব্যের তোতাগান তখনো পুরোদমে চলছে। ভারতচন্দ্রের ঈশ্বরী পাটনির দাঁড় টানার শব্দ তখনো সাহিত্যে শোনা যায়নি।


 সেই বেমানান যুগ পরিবেশে রক্তমাংসে গড়া মানব-মানবীর হাসি-অশ্রুভরা প্রণয় কাহিনীর কাব্যরূপায়নে বাংলার আধুনিক জাতীয় সাহিত্যের ভিত্তিস্থাপনা করে গেলেন দুই মুসলমান কবি – একি আশ্চর্যের নয়। তাই মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয় স্রষ্টা তারা না হলেও ভোরবেলার উদীয়মান শুকতারা।


👉👉   মুসলিম সাহিত্য কবি সৈয়দ আলাওল ও তার রচিত পদ্মাবতী কাব্য নিয়ে আমরা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করেছি, এটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তবে অবশ্যই আমাদের কমেন্ট করে জানাবেন ও প্রয়োজনে আমাদের ফেসবুক পেজটি ফলো করে রাখতে পারেন ।