মনসা মঙ্গলের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ (Ketokadash) - কবি পরিচয় ও কাব্য পরিচয় সম্পর্কে আলোচনা - pdf
বাংলা মঙ্গল সাহিত্যের ইতিহাসে যে সকল কবি বর্গ নিজস্ব প্রতিভাতে উজ্জ্বল হয়ে আছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনসামঙ্গলের কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ ( Ketokadash-Khamanandi )। এই পর্বে আমরা কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ তার কবি পরিচয় ও কাব্য কৃতিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলাম -
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ মনসামঙ্গলের একজন শ্রেষ্ঠ কবি। চৈতন্য পরবর্তী মনসামঙ্গল কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে কেতকাদাস একটি বিশিষ্ট নাম। কেতকাদাসের কাব্য পশ্চিমবাংলায় অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
কবিপরিচয়
কেতকাদাসের নিস্তৃত পরিচয় কিছু জানতে পাড়া যায় না। তবে তিনি নিজের অগ্রবর্তী কবি মুকুন্দরামের অনুসরণ করে তাঁর কাব্যের মধ্যেও একটি আত্মবিবরণী প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তাঁর আত্মবিবরণীতে সাল তারিখের কোন উল্লেখ নেই তবুও তিনি কয়েকটি ঐতিহাসিক তথ্যের উল্লেখ করেছেন যা তাঁর কালের পরিচয় বহন করে।
এই আত্মবিবরণীতে তিনি বারা খাঁর উল্লেখ করেছেন। এই বারা খাঁ দক্ষিণ রাঢ়ে অবস্থিত সেলিমবাদ সরকারের শাসনকর্তা ছিলেন। ১৬৪০ খ্রীষ্টাব্দে বারা খাঁ প্রদত্ত একটি দানপত্র পাওয়া গেছে। এইসময়ে পর তিনি যুদ্ধে মারা যান এবং তারপর কেতকাদাসের মনসামঙ্গল রচিত হয়।
![]() |
Educostudy.In/Ketokadash |
অতএব মনে হয় সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তাঁর কাব্য রচিত। এছাড়া তাঁর আত্মবিবরনীতে উল্লেখিত বিষ্ণুদাস ও ভারমল্ল ঐতিহাসিক ব্যক্তি যারা সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বর্তমান ছিলেন। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্যে চৈতন্যদেবের উল্লেখ যেমন আছে তেমনি কবি মুকুন্দরামের অনুকরণে অনেক ছবিও রচিত হয়েছে।
এমনকি মুকুন্দরামের ভাষারও প্রতিধ্বনি আছে। তাই সবদিক বিবেচনা করে মনে হয় কবি সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের মানুষ। বর্ধমানের কাঁদড়া গ্রামের অধিবাসী ছিলেন তিনি। কেয়াপাতায় জন্ম হয়েছিল বলে মনসার আরেক নাম কেতকা। কবি মনসার পরম ভক্ত বলেই কেতকাদাস এই উপাধিটি ব্যবহার করেছেন বারবার। বিচিত্র পরিবেশ ও অবস্থার মধ্যে কবির বাল্যজীবন অতিবাহিত হয়। ভারমল্লের কাছ থেকে তিনটি গ্রাম তিনি দানস্বরূপ গ্রহণ করেন।
কাব্যপরিচয় ও কবিত্বঃ
মঙ্গলকাব্য সাহিত্যে একটি প্রচলিত প্রথা দেবী দর্শন ও দেবী স্বপ্নাদেশ প্রাপ্তি। একদিন সন্ধ্যাবেলায় জমিতে ধান কাটতে গিয়ে সর্পভূষণা দেবী মুচিনীর বেশে দেখা দিয়ে আদেশ দেন-
ওরে পুত্র ক্ষেমানন্দ কবিত্বে কর প্রবন্ধ
আমার মঙ্গল গাইয়া বুল।
প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন
কবি অবশ্যি পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। এই পাণ্ডিত্যের নিদর্শন তাঁর কাব্যে ভুরি ভুরি মেলে। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক জ্ঞানও তাঁর যথেষ্ঠ ছিল তার প্রমাণ রয়েছে বেহুলার স্বর্গপুরী অভিমুখে যাত্রার বর্ননার মধ্যে। কলার মান্দাসে বেহুলা স্বর্গের দিকে ভেসে চলেছেন।
কবি সাঁতালি থেকে স্বর্গ পর্যন্ত যাত্রাপথের দামোদর সহ শাখানদীগুলির নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। এমনকি যে ২২ টি ঘাটের উল্লেখ করেছেন তার অনেকগুলি আজও খুঁজে পাওয়া যায়। এই বাস্তবমুখিনতা ছাড়াও সহৃদয়তা ও সরলতা ক্ষেমানন্দের কাব্যবৈশিষ্ট্য। লখীন্দর মারা গেছে, শোকাশ্রু চরিত্র নির্মাণে কবি অপূর্ব দক্ষতা দেখিয়েছেন।
সনাতন ভারতীয় নারীত্বের উজ্জ্বল পবিত্রতার আদর্শে, অবিচল দুঃখসহা ক্ষমতায় একদিকে বেহুলা মহিমান্বিত, অপরদিকে আত্মমর্যাদার দীপ্ত মশাল আলোয় সে উজ্জীবিত। তার গর্বময়ী বক্তিত্ব লখীন্দরের মৃত্যুর পরে প্রকাশ পেয়েছে-
মা বাপের বাড়ীতে আমারে নাহি সাজে।
সকল ভাইদের সঙ্গে মোর দ্বন্দ্ব বাজে।।
সহিতে না পারি আমি দুরক্ষর বাণী।
কূলে দাঁড়াইয়া ভাই আর কান্দ কেনি।
বেহুলা তাই আদর্শের প্রতিলিপি নয়, বেদনায় দুঃখে রক্তমাংসের জেবন্ত মানুষ। সনকার দুঃখের কথাও ভারী সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করেছেন কবি –
হাপুতির পুত মোত বাছা লখীন্।
তোমা লাগি গড়াইলাম লোহার বাস।।
কার শাপে ফলিল কে মোরে দিল গা।
বংশে কেহ না রহিল দিতে জলাঞ্জলি।।
মনসার ঈর্ষাব্যাকুল চরিত্র কবির হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিষপানে শিবের মৃত্যুতে বিমাতা বিধবা হবে জানে মনসা নির্দয় আনন্দে বলে ওঠে –
আজি মনে প্রতি হইল শুনি সমাচার।
এতদিনে চণ্ডীর ছুটিল অহংকার।।
হেমন্ত ঋষির বেটির গর্ব হইল চূর্ণ।
মনসার মনোবাঞ্ছা হইল সম্পূর্ণ।।
বিষপানে মরিল মহেশ মোর বাপ।
চণ্ডীকা রাণ্ডিকা হইল ঘুচিল সন্তাপ।।
কেতকাদাসের কাব্যের আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাঁর কাব্য অশ্লীলতার পঙ্ককুণ্ডে নামেনি। চৈতন্য প্রভাবেই হোক বা মুকুন্দরামের অনুকৃতিতেই হোক কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের কাব্যে রুচিহীন গ্রাম্যতা প্রশ্রয় পায়নি।
প্রশ্নটির উত্তর পিডিএফ আকারে পেতে এখানে ক্লিক করুন
অলংকারের অভিনবত্ব রয়েছে, রয়েছে তৎসম শব্দের উপযুক্ত ব্যবহার। কিন্তু কাহিনী গ্রন্থনে প্রতিভার ছাপ নেই। জীবনের বহিরঙ্গের কবি তিনি। অন্তর্লোকের জালজটিল চিত্র আঁকার অবসর এ কবির ছিল না। তবু জনপ্রিয়তায় অনেককে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন। সাহিত্য বিচারে তাঁর কাব্য এমনকিছু উচ্চাঙ্গের নয়, তবুও পাঠক তা পড়েছে।
👉👉 বাংলা মঙ্গলকাব্য অধ্যায়ের বিশিষ্ট শাখা মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। এছাড়াও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়গুলি সম্পর্কে জানতে ওতাদের উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ নোটস পেতে উপরে লিংক দেওয়া থাকলো।
মনসামঙ্গল কাব্যের গোদা চরিত্রের বর্ণনা
উত্তরমুছুন