বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা করো

    মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য যেভাবে পুরানো রীতি - সংস্কৃতি ত্যাগ করে নতুন ধারায় পুষ্টি পেয়েছিল তারি পরবর্তী ধাপ ছিল আধুনিক সাহিত্য। আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টির পথ প্রশস্ত ও মসৃণ করেছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগপুরুষ' রাজা রামমোহন রায়। 

বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান
Educostudy.In/RajaRamMohan-Roy


   এই সময়ের বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির এক প্রবল উন্মাদনা জন্মেছিল যদিও তার হাতে খড়ি হয়েছিল ব্রিটিশদের হাতে। তবুও বহু বাঙালি বরেণ্য পন্ডিত পাশ্চাত্যের রীতিনীতিকে হৃদয়াঙ্গম করে প্রাচ্যের ভাবধারা তে পরিবর্তন করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি করেছিল।


   এইরকম একজন পন্ডিত রাজা রামমোহন রায়। আমরা এখানে রাজা রামমোহন রায়ের বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে যে অবদান তা নিয়ে আলোচনা করলাম। 


 রাজা রামমোহন রায়

জাতীয় জীবন আর সাহিত্যের অগ্রগতি সমানুপাতিক হারে না এগোলেও, একজনের মুক্তি ও বৃদ্ধি অপরটির পক্ষেও একই ফল ঘটাতে সক্ষম। আবার সাহিত্য জীবনের অগণন ক্রিয়াকলাপের শৈল্পিক প্রকাশও বটে।


   সেই কারণেই ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ঘণ্টায় যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হল, রুদ্ধদ্বার প্রাচ্যের অন্ধকার ঘরে প্রতীচ্যের নবোদ্ভূত আলোক সভ্যতার রশ্মি এসে পড়ল; তখনই বোঝা গিয়েছিল রুচিহীন ইতর কাব্যভাষার তরল কাঁচামাটির পথ ছেড়ে ভিন্নতর পথপ্রান্তে বাংলা সাহিত্য উপনীত হয়েছে।


   সে পথ রাজপথ না হলেও এই গ্রাম বাংলার শক্ত-পোক্ত রাঙামাটির মেঠো পথেই গদ্যভাষার রথযাত্রা শুরু হয়েছিল। রামমোহনই সেই যুগন্ধর ব্যক্তিত্ব যিনি সাহিত্যের এই নতুন পথের কারিগর আর নতুন রথের সারথি।


  রামমোহন যে জাতিটার পুরোভাগে দাঁড়িয়ে ছিল শতাব্দীর জীর্ণ সংস্কারের ভারে তা অবসন্ন, অবক্ষয়ের নৈশ কালিমা তার আঁখিতলে। ফলে রামমোহনের মনীষা নিজের লেখনীতে জাতি প্রগতির বার্তাকেই স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছিল।


রামমোহনের লেখাগুলি প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।–


প্রথমতঃ ধর্ম ও তত্ত্বগত আলোচনা


বেদান্তগ্রন্থ – ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দ

বেদান্তসার – ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দ

ভট্টাচার্যের সহিত বিচার – ১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দ

গোস্বামীর সহিত বিচার – ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ

কবিতাকারের সহিত বিচার – ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দ

ব্রাহ্মণ সেবধি ব্রাহ্মণ ও মিশনারী সম্বাদ – ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দ

চারি প্রশ্নের উত্তর – ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দ

পাদরি ও শিষ্য সংবাদ – ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দ

গুরুপাদুকা – ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দ

প্রার্থনা পত্র – ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দ

ব্রহ্মোপসনা – ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দ

অনুষ্ঠান – ১৮২৯



দ্বিতীয়তঃ সামাজিক আচার ও প্রথা বিষয়ক রচনা


সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ (১ম খণ্ড) – ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ

সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ (২য় খণ্ড) – ১৮২৮ খ্রীষ্টাব্দ

সুব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার – ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দ

পথ্যপ্রদান – ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দ

কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক রচনা – ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দ

ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থের লক্ষণ – ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দ

সহমরণ বিষয় – ১৮২৯ খ্রীষ্টাব্দ

গৌড়ীয় ব্যাকরণ – ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দ (মৃত্যুর পর প্রকাশিত)


রামমোহন ব্রহ্মবাদী বলে একেশ্বরবাদের অর্থ তাঁর মূলমন্ত্র ছিল। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, দর্শন বেকন, নিউটন, ভলতেয়ার, রুশো প্রভৃতি মনীষীদের রচনাও মনে প্রভাব ফেলেছিল। তিনি তাঁর সংগৃহীত জ্ঞান অবলম্বনে বেদান্ত ও উপনিষদের অনুবাদ করেন। ১৮১৫-তে প্রকাশিত হয় ‘বেদান্তগ্রন্থ’। তিনি দোম আন্তোনীয় এর ‘ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সম্বাদ’ – এর ধর্মতত্ত্বের মতো বেদান্তের আলোচনা করেছেন।


১৮১৬-১৮১৯ – এর মধ্যে তিনি বেশ কয়েকটি উপনিষদের অনুবাদ করেন। প্রথম যৌবনে বারাণসীতে বেদ উপনিষদ পাঠ করেছিলেন এবং ওল্ড টেস্টামেণ্ট ও নিউ টেস্টামেণ্ট অধ্যয়ন করে তিনি একেশ্বরবাদ ধারণায় পৌঁছান। এর নিদর্শন আছে অনুবাদগুলিতে।


সমস্ত জীবন ধরে রামমোহনকে শাস্ত্র ব্যাখ্যা আর লেকচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। শাস্ত্রবাণীর সঙ্গে ক্ষুরধার যুক্তির সমন্বয়ে রচিত হয়েছিল ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্তক নিবর্তক সম্বাদ’ গ্রন্থ দুটি।


‘কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার’, ‘গুরুপাদুকা’, ‘অনুষ্ঠান’ – এসব গ্রন্থগুলি অতি সংক্ষিপ্ত। ব্রহ্মসঙ্গীত নামে একটি গ্রন্থে প্রায় ৩২টি রামমোহনের লেখা গান সংকলিত আছে। বিবেক-বৈরাগ্য, ব্রহ্মবন্দনা প্রভৃতি এদের বিষয়।


রামমোহনের বিশেষ কৃতিত্ব ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ রচনায়। বইটিতে রয়েছে ৪টি অধ্যায় – উচ্চারণ শুদ্ধি, লিপি শুদ্ধি, পদবিধান, লিঙ্গ-বচন। এই বইতে তদ্ভব ও দেশী শব্দের যথেষ্ট ব্যবহার আছে – বাজার, ধন, কামারণী, ঢাকাই কাপড়, গাছকাটা, তালপুকুর ইত্যাদি।


রামমোহন সাহিত্যকে বিবাদ-বিতর্কের মাধ্যম বলেই ভেবেছিলেন – এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য, এটাই তাঁর ত্রুটি। তবে একথা ঠিক বাংলা গদ্য যখন রাষ্ট্রশাসনগত ও নানারকম সামাজিক সংস্কারে আবদ্ধ ছিল সেই সময় রামমোহন বাংলা গদ্যের চলার পথটি নির্ণয় করেন।



সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

1. প্রকাশকালসহ রামমোহন রায়ের রচিত গ্রন্থগুলির নাম লেখ।

উঃ

সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদঃ

বেদান্ত গ্রন্থ – ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দ

বেদান্ত সার – ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দ

উপনিষদের অনুবাদ – ১৮১৫-১৯ খ্রীষ্টাব্দ


বিতর্কমূলক রচনাঃ

উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশ – ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ

গোস্বামীর সহিত বিচার – ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ

সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক-নিবর্তক সম্বাদ – ১৮১৮-১৯ খ্রীষ্টাব্দ

কবিতাকারের সহিত বিচার – ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দ

ব্রাহ্মণসেবধি – ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দ

পথ্যপ্রদান – ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দ

সহমরণ বিষয়ক – ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দ

2. রামমোহনের রচিত ব্যাকরণ গ্রন্থটির নাম কী?

উঃ গৌড়ীয় ব্যাকরণ – ১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দ


👉👉   কি সমাজ, কি রাজনীতি, কি শিক্ষা-দীক্ষা নেই যার প্রতি তিনি অনুরাগী ছিলেন না। বাংলা গদ্যের বিকাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, শ্রীরামপুর মিশনের অবদান উল্লেখযোগ্য। এই দুটি প্রতিষ্ঠান কে বাদ দিয়ে যিনি সর্বপ্রথম সাহিত্যের রং মশালে আধুনিকতার তুলি টেনে ছিলেন তিনি রাজা রামমোহন রায়। 

   এখানে তার বিভিন্ন গ্রন্থ বিভিন্ন অবদান ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ও এই বিষয়ে থেকে যেসকল সংক্ষিপ্ত প্রশ্নাবলী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া বাংলা সাহিত্যের অন্য প্রশ্ন গুলো পেতে এখানে ক্লিক করুন।